একজন ভ্রাতার গল্প, জাগো ভগিনী

লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব ২৩ জুন, ২০১৪, ০৫:৫৬:৫২ বিকাল

আম্মু বলেছেন, ‘আমার ছেলে পাগল হলেও মাথা ঠিক আছে।’ ঠিক অস্বীকার করবার মতো অবশ্য নয়। মাঝে মাঝে মাথায় যে ঝোঁক হঠাৎ চাপে, তাতে আম্মুর মন্তব্য ঠিক না হয়ে যাবে কই? ভালোবাসার মানুষদের একটা চূড়ান্ত লিস্ট আছে আমার কাছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের সাথে আমার কখনো সাক্ষাত হয় নি, কথাও হয় নি! হা হা হা! অনেককে জানানোই হয় নি ভালোবাসার কথা। লিস্টটা মাঝে মাঝে সংযোজন হয়, তবে বিয়োজনের কোন অপশন খোলা নেই এখানে।

হাসছেন? হাসুন প্রাণ খুলে, কোন অসুবিধা নেই! আরো শোনেন, একবার মাথায় আসলো কি, আমার ঈর্ষার মানুষদেরও একটা লিস্ট হওয়া প্রয়োজন। তখন ক্লাস টেনে পড়ছি। ডায়েরিতে একটা পাতার উপর সাইন পেন দিয়ে শিরোনাম লিখলাম “আমি যাদের ঈর্ষা করি”।

ইতিহাস ক্লাসে স্যার সীরাহ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পর আমি খুব তাড়াতাড়ি ডায়েরি খুলে সেই পাতার শুরুতে লিখে ফেললাম:

১। খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ (রা.)

স্যার কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। সামনের সারিতেই ছিলাম আমি। এতক্ষণ যে খাতায় নোট করছিলাম, সেটা বাদ দিয়ে হঠাৎ ডায়েরি খোলা দেখে স্যার মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেখতে পারি কবি সাহেব?’ আমি এগিয়ে দিলাম। স্যার পড়ে শোনালেন:

আমি যাঁদের ঈর্ষা করি

১। খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ (রা.)

কেনো?

বলছি!

তার পূর্বে…

তখন ক্লাস থ্রি-তে আমি। চারপাশের জগতটাকে দেখানো শেখাতে শুরু করেছেন আব্বু। বাড়ির ছাদে বিকেল বেলা আব্বু, আমি আর রুবাইয়া- তিনজনের আড্ডা হতো। পিঁয়াজ-তেলে মুড়ি ভাজা নিয়ে এসে আম্মুও যোগ দিতেন। আড্ডা বলতে আব্বুর গল্প শোনানো, সাথে নিয়ে আসা নতুন কোন ম্যাগাজিন বা বইয়ের চমকপ্রদ অংশটা আমাদের পড়ে শোনানো- এই তো। টিভি ছিলো না (এখনো নেই)। মোবাইল ফোন আগমনের কথাবার্তা আশেপাশে শোনা যাচ্ছিলো, তবে আমাদের বাড়িতে আসে নি তখনো। কতো চমৎকার ছিলো আমাদের সেই নির্মল বিকেলগুলো!

যাই হোক, একটু একটু করে প্রিয় নবীজিকে জানতে শুরু করেছি সেই আসরে। জন্মের আগে বাবা হারানো, খুব শৈশবে প্রিয় মায়ের বিদায়, তারপর দাদা, একে একে চাচা-ও! কেঁদেছিলাম খুব খুব। প্রিয় নবীজির প্রতি অন্য রকম ভালোবাসার অঙ্কুরোদগম হচ্ছিলো হৃদয়ে। টেপ রেকর্ডারে আমাদের খুব গান শোনার বাতিক ছিলো। আমি আর রুবাইয়া তো অনেকবার টাকা জমিয়ে সেই ফিতাওয়ালা ক্যাসেট কিনেছি! বাড়িতে তখন সবার প্রিয় ছিলো শিশুশিল্পী হাসনা হেনা আফরিনের গান। আমি শুনতাম আইসিএস থেকে প্রযোজিত অ্যালবামগুলো। এরই মধ্যে ছোট চাচু নিয়ে এলেন নতুন এক অ্যালবাম। খুব আগ্রহ ভরে শুনলাম সবাই মিলে। ছোটদের কণ্ঠে গাওয়া একটা গান কিভাবে বুকের খুব খুব গভীরে বিঁধে গেলো:

“জন্ম যদি হতো মোদের রাসূল পাকের কালে

আহা, রাসূল পাকের দেশে!

মোদের তিনি কাছে টেনে চুমু দিতেন গালে

আহা, কতই ভালোবেসে!”

গুনগুন করে সারাদিন শুধু এই গান গেয়েছি গভীর অনুরাগে। নামটা ঠিক স্মরণ নেই, তখন কি যেনো একটা মাসিক পত্রিকায় সিরিজ লেখা চলছিলো ‘মহানবীর বাড়িতে একদিন’। আব্বু আমাকে সাথে নিয়ে পড়া শুরু করলেন।

আমাকে স্লো পয়জনিং প্রক্রিয়ায় রাসূলুল্লার সুন্নাহ-গুলোর সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করেছেন আব্বু। পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে আগে সালাম দেয়া, মুচকি হাসা, হাঁচির জবাব- এই এই আরো অনেক…। তারপর খাবারের প্রসঙ্গ। পানি পাত্রে দেখে নিয়ে তিনবারে বসে খাওয়া, পেটভর্তি করে খাবার না খাওয়া- অভ্যাসটা শৈশব থেকে আলহামদুলিল্লাহ চলছে। প্রিয় নবীজির পোষাকের ব্যাপার এলো। আমি তখন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ি, স্বাভাবিক পোষাকেই অভ্যস্ত। এবার খুব শখ করে আব্বুকে ভালোভাবে বায়না ধরলাম লম্বা জামা বানিয়ে দিতে। পেয়েও গেলাম… সেই ধারা থামেনি আজো। মিসওয়াক তো ছিলো-ই।

সব ঠিক আছে, বিপত্তি অন্য জায়গায়। আমার যে দাঁড়ি নেই! কি হবে এখন? রুবাইয়ার সাথে গোপনে পরামর্শ করে স্থির করলাম, কলম দিয়ে মুখে দাঁড়ি আঁকা হবে! ব্যস, যেমন ভাবা তেমন কাজ; আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে আঁকা হলো। স্কুলে তো সবাই হেসে কুটি কুটি! বাড়িতেও একি অবস্থা। ব্যতিক্রম আম্মু আর দাদুভাই। আব্বু প্রাণ খুলে হাসেন। ভালোবাসার পরিমাণটা মধ্যে একবার এতোই বেড়েছিলো, যখন শুনলাম প্রিয়নবীজি জুতো সেলাই করেছেন, আমিও একবার সেলাই করেছি নিজ হাতে! আব্বু অবশ্য পরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমাদের জন্যে কোন্ সুন্নাহটা অবশ্য পালনীয়, কোনটা ঐচ্ছিক এবং কোনটা প্রিয়নবী নিজেই নিষেধ করেছেন পালন করতে।

আলহামদুলিল্লাহ, আমার জীবনের রোল মডেল হিসেবে রাসূলুল্লাহকে গ্রহণ করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে আমি প্রশিক্ষণ পেয়েছি শৈশবে। সেই যে আমার ভালোবাসা, ভালোলাগা আর আবেগ-অনুরাগের পাত্র বানিয়েছি চর্মচোখে না দেখা এই প্রিয় মানুষটিকে… একটু বড় হয়ে যেখানে যা পেয়েছি সীরাহ বিষয়ে, পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছি।

আমার সীরাহ পাঠের একটা দিক হলো, রাসূলুল্লাহর জীবনের কোন অংশের সাথে কোন ভাবে জড়িত প্রশান্ত আত্মাগুলোর প্রতি ক্রমশ দুর্বলতা অনুভব করি এবং ভালোবাসা মিশ্রিত একটা অস্ফূট ঈর্ষা জেগে ওঠে। আর আমার গুনগুন করে গাওয়া গানটা বারবার তাড়া করে ফেরে মন মুকুরে, ‘জন্ম যদি হতো মোদের….’!

ক্লাসে সীরাহ আলোচনার সময় খাদীজা’র প্রসঙ্গটা এমনিভাবেই বুকে এসে বাজছিলো আমার। প্রথম ওহী অবতরণের ঘটনায় প্রিয় নবীজি কতোটা অপ্রস্তুত এবং শঙ্কিত হয়েছিলেন, আমরা তো জানিই। তারপর চিন্তা করুন, খাদীজা কতো সুন্দর ভাবে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন! ভরসা এবং অভয় দিয়েছিলেন! আপনি ভাবতে পারবেন না, রাসূলুল্লাহ এমনকি সে সময় প্রাণনাশেরও আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু কি যাদু ছিলো এই রমণীর কথায়, তাঁর ভরসায়…? সেই তিনিই আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব পালনে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন?

শুধু তাই নয়, নিজের সঞ্চিত সমস্ত বৈভব নবুওয়তী মিশনের জন্যে চোখ বন্ধ করেই বিলিয়ে দিলেন…! কতোটুকু প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হলে মানুষ এমনটি পারে, বলুন? সবচে’ বড়ো কথা… ঘোর তমসার বুক চিরে যেই মশালটি উন্মেষের অপেক্ষায় ছিলো, দমকা হাওয়ায় সেই মশালটিকে প্রথম শক্ত হাতে ধরেছিলেন এই সাহসী রমণী-ই! তাঁকে না করে আর কাকে ঈর্ষা করবো আমি?

আমার ঈর্ষার তালিকায় দু’ নম্বরে ছিলেন আবূ বাকর আস-সিদ্দীক্ব (রদ্বিয়াল্লাহু ’আনহু)। কতটুকু দুর্বিনীত প্রত্যয়ের অধিকারী হলে বিনীত বিশ্বাসে এভাবে কেউ মস্তক অবনত করতে পারে, ভেবে দেখেছেন? তারপর… হিজরতের সেই সময়টা? সাওর গুহার অনিশ্চিত রাত্রিগুলো! ভাবা যায়? প্রিয় নবীর ভালোবাসায় বিষাক্ত নাগিনীর দংশন নীরবেই সয়ে যাওয়া…! আহঃ! শুধু কি আমিই? ‘উমার (রদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-ও কিন্তু তাঁকে ঈর্ষা করতেন। ঐ যে, এক তাঁবুতে স্বজনহারা বৃদ্ধার সেবা করতে দু’জনের লুকোচুরি প্রতিযোগিতা! জানেনই তো।

সাওর গুহার বিপদসংকুল সময়গুলোতে আরেকটি গল্প আমরা জানি। চারিদিকে শত্রুদের আনাগোনা। শত্রু আবার কী? রক্ত-পিপাসার নেশায় উন্মত্ত হিংস্র হায়েনা যেনো! শিকার পেলে যে কি না এক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়বে জান্তব উল্লাসে। তার উপর আবার গোপন নজরদারি। চিন্তা করুন, সেই কঠিন থেকে কঠিনতর সময়গুলোতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নবীজি এবং আবূ বাকর-কে খাবার পৌঁছিয়ে দিতেন একজন নারী! বাইরের পরিস্থিতিও তাঁদেরকে কৌশলে জানিয়ে দিতেন তিনি। শুধু কি তাই? রাসুলুল্লাহ এবং আবূ বাকরের অবস্থান সম্পর্কে তাঁকে আবূ জাহলের মতো বিভৎস ভয়ঙ্কর নরপশু জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তিনি মুখের উপর সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না!’ নির্দয় আবূ জাহলের হাতে তিনি প্রহৃতা হলেন, তবু মুখ খোলেন নি। কে তিনি?

ঠিক ধরেছেন, তিনি আসমা বিনতু আবি বাকর (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা)! ইনি আমার ঈর্ষার তালিকায় তৃতীয়।

মদিনায় আগমনের পর ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা হেলে দুলে প্রিয় নবীকে স্বাগত জানাচ্ছিলো। গলা ছেড়ে গাইতে থাকে, ‘তালা’আল বাদরু আলাইনা, মিন সানিয়াতিল ওয়াদা; ওয়াজাবা আশ-শুকরু আলাইনা, মাদা’আ লিল্লাহিদা….’। আহ, আমি যদি থাকতাম মদিনার সেই কিশোরদের দলে…!

তারপর…তারপর…সবার মনেই সুপ্ত বাসনা, নবীজি যদি আমার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন! নিজেকে ধন্য করার জন্যে সবাই উৎসুক। সেই প্রতীক্ষারও কতো পবিত্র অনুভূতি! সুবহানাল্লাহ! অবশেষে… কী হলো? সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হলেন সাহাবী আবূ আইয়ুব আল-আনসারী (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)। উঁহু, কতো না ভাগ্যবান তিনি! না, শুধু তিনি নন, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীও রাসূলকে নিজেদের ঘরে অতিথি হিসেবে পেয়ে যারপরনাই উদ্বেলিত হয়েছিলেন। প্রিয়নবীজির ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে নীচতলায় শোয়ার ব্যবস্থা করে তাঁরা দু’জন দোতলায় শুয়েছিলেন। মজার বিষয় হলো, তাঁরা কিন্তু একরত্তি ঘুমোতে পারেন নি রাত্রে। কেনো? দু’জনেই খুব অস্বস্তিতে ছিলেন, প্রিয়নবীকে নীচ তলায় রেখে তাঁদের এখানে অবস্থানটা আবার রাসূলের শানে কোন গোস্তাকী হচ্ছে কি না…! আরেকবার ভাবলেন, দু’জনের অবস্থানটা আবার ঠিক বরাবর রাসূলের মাথার উপরেই আছে কি না…! এ জন্যে বারবার বিছানাটা এ দিক ও দিক করেছেন। এরই মধ্যে ঘটে গেলো আরেক ব্যাপার, এই অস্বস্তিকর সময়ে অস্থিরতায় তাদের পানির কলসটা হঠাৎ হেলে পড়লো। আর যায় কই, সব পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। দু’জন তো ভয়ে, শঙ্কায় আরো অস্থির হয়ে উঠলেন! কি আর করবেন, নিজেদের কম্বলটাই পানির ওপর দিয়ে দিলেন, যাতে কম্বল পানি চুষে নেয় এবং গড়িয়ে নীচ তলায় না যায়; ওখানে যে প্রিয়নবী শুয়ে আছেন! আহারে, পুরো রাত তাঁরা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপলেন। সকালে এই ব্যাপার রাসূলুল্লাহ শুনতে পেলেন এবং সেদিন থেকে তিনি তাদের নীচতলায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে দোতলায় অবস্থান গ্রহণ করলেন।

গল্প তো শুনে ফেলেছেন! ব্যাপার হলো কি, আমার ঈর্ষার তালিকায় চতুর্থ এবং পঞ্চম হলেন ইনারা দু’জন!

সেই হিজরতের সময়কারই আরেকটি চমৎকার গল্প বলি।

প্রিয় নবীকে পেয়ে তো সবার মনেই খুশির জোয়ার, তাই না? কে কি গিফট করবেন রাসূলকে, কূল-কিনারা পাচ্ছেন না। আবেগঘন আনন্দের সময় যা হয় আর কি! কেউ তাঁকে কবিতা নিবেদন করছেন, কেউ তাঁর নিজ বাগান থেকে খেজুরের থোকা নিয়ে আসছেন…এই এই আরো কত কি!

কিন্তু একজনের নিবেদন ছিলো একেবারেই ব্যতিক্রম! তাঁর সাধ্যে এমন কিছু ছিলো না, যা তিনি প্রিয়তম রাসূলকে নিবেদন করবেন। অবশেষে…নিজের কিশোর পুত্রকেই প্রিয়নবীর খিদমাহ-তে পেশ করলেন। পুত্রও যারপরনাই খুশি হয়ে রাসূলের ছায়ায় নিজেকে ধন্য মনে করলেন! বলুন, এর চে’ বড়ো আন্তরিক নিবেদন আর কি হতে পারে? কে তিনি? তিনি ধন্য রমণী গুমাইছা বিনত মিলহান (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা)। আর কে সেই ভাগ্যবান কিশোর? তিনি আনাস ইবন মালিক (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)।

অতঃপর তালিকার ষষ্ঠ ও সপ্তম অবস্থানে থাকা দু’জন ভাগ্যবানের সাথে আপনারা পরিচিত হলেন।

এবারের গল্প শুনে তো আপনি নিজেই ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরে যেতে চাইবেন! আই অ্যাম শিওর, মোর দ্যান শিওর!

v

চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন তো, রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষের কাছে স্বয়ং জিবরাঈল (‘আলাইহিস সালাম) এসে সালাম পৌঁছাবেন; তিনি কি দুর্দান্ত সৌভাগ্যের অধিকারী!! পৃথিবীতে তো বটেই, জান্নাতেও রাসূলুল্লাহর সাহচর্যের সুসংবাদ পেয়েছেন আল্লাহর কাছ থেকেই! আপনি ভাবছেন, ইনি মানুষ না অন্য কিছু….!?

হুম! ইনি হলেন ‘আয়িশা বিনত আবি বাকর (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)। প্রিয়নবীকে নিবেদিত তাঁর কবিতাটা পড়েছেন তো? আমি ইতোপূর্বে সেটার একটা কাব্যিক অনুবাদও শেয়ার করেছি। শুধু এটাই কেন, তাঁর আরো অসংখ্য কবিতা আছে; পড়লে আপনি নিজেই বলবেন, ‘ইহারে ঈর্ষা না করিয়া কাহারে করিব আমি!’ আপনি শুনলে অবাকই হবেন, তাঁর কতো দিকে দখল ছিলো! আবূ মূসা আশ’আরীর নাম শুনেছেন না? তাঁর স্বীকৃতি শুনুন, ‘আমাদের কোন হাদিসের ব্যাপারে যদি কোনো সন্দেহ হতো, তখন ‘আয়িশাকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে পারতাম’।

মাদরাসার ছাত্ররা জানেন ‘ইলমুল ফারায়িদ্ব (ইসলামী উত্তরাধিকার বণ্টন নীতি) কতো জটিল এবং সূক্ষ্ম বিষয়। ডোন্ট ওরি, সাহাবীরাও কিন্তু মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়ে যেতেন এই বিষয়টিতে। তখন তাঁরা কি করতেন জানেন? সোজা ‘আয়িশার কাছে চলে আসতেন! সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তো আছেনই তিনি (মোট ২২১০টি)। এবার মজার গল্প বলি। রাসূলুল্লাহ একবার ‘আয়িশার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিলেন। সেবার ‘আয়িশা বিজয়ী হলেন। আরেকবার প্রতিযোগিতা দিয়ে ‘আয়িশাকে পেছনে ফেলে দিলেন এবং বললেন, ‘শোন, এটা ঐদিনের প্রতিশোধ!’

জীবনের অন্তিম সময়ে প্রিয়নবীকে আগলে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর সান্নিধ্যেই প্রিয়নবী আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছেন। তাঁর কক্ষেই প্রিয়নবী আজো শুয়ে আছেন। কতো না সৌভাগ্যবতী তিনি! তিনি আমার অষ্টম ঈর্ষা।

আচ্ছা বলুন তো, প্রিয়নবীকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে তাঁর চে’ বেশি কে আছেন? রাসূলের এমনই কাছের মানুষটিই তো ভালো বলতে পারবেন, কেমন ছিলেন তিনি! নাকি? আবার প্রিয়নবীর চরিত্র, স্বভাব ইত্যাদির সাথে কার বেশি মিল আছে, সেটাও অন্যদের চে’ নিশ্চয় তিনি ভালো বলতে পারবেন! তাই না?

তবে শুনুন তাঁর কথা: “আমি কথা-বার্তা, আচার-আচরণে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে সাদৃশ্যময় ফাতিমার চে’ আর কাউকে দেখিনি। এমনকি তাঁর হাটা-চলাও ছিলো রাসূলের হাঁটা চলার মতো।” [সাহীহ আল-বুখারী]

কখনো কোন পুরুষ সাহাবীর ব্যাপারে এমনটি শুনেছেন আপনারা কেউ? ভগিনীগণ গর্ব করতে পারেন এটা নিয়ে!! কারণও আছে, নবীজির ভাষায় জান্নাতে আপনাদের মধ্যমণি হবেন কিন্তু তিনি-ই!

প্রিয়নবী এতোটাই ভালোবাসতেন তাঁকে, কখনো কোন সফর থেকে ফিরলে প্রথমেই মাসজিদ ঢুকে দু’ রাকাত সালাহ আদায় করতেন, এরপর ফাতিমার গৃহে গিয়ে তাঁর খোঁজ-খবর নিতেন, তারপর উম্মাহাতুল মু’মিনীন-দের খোঁজ নিতেন।

ঈর্ষারে ঈর্ষা!! কি আর করা, তালিকার নয় নম্বরে তাঁকে নিয়ে নিলাম।

আমরা শেষ পর্যায়ে এসে একটু পেছন ফিরে তাকাই। দশম ঈর্ষা। আপনাদের মনে আছে, মাক্কী জীবনের সেই আগুন ঝরা দিনগুলোর কথা? সেই রক্ত-পিচ্ছিল পথের যাত্রীদের তেজোদ্দীপ্ত ঈমান, কল্পনা করতে পারেন? একজন স্বাধীন মানুষ যেখানে ঈমানের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথেই পাশবিক নির্যাতন আর লাঞ্ছনার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতেন, সেখানে একজন ক্রীতদাসী কতটুকু ঈমানের জোর হলে কালিমার দৃপ্ত উচ্চারণের সাহস করতে পারেন? ভেবেছেন কখনো?

বলছিলাম আম্মার (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র স্নেহময়ী জননী সুমাইয়ার কথা। চিন্তা করুন, অমানুষিক নির্যাতনের মুখে এই মহিলা যদি একটিবার শুধু বলতেন, ‘আমি দ্বীন ত্যাগ করলাম’…তাহলেই নিষ্কৃতি পেতেন। কিন্তু এই একটি বাক্য উচ্চারণ করা তাঁর কাছে পাশবিক নিষ্পেষণের চেয়েও বেশি ভয়ানক কঠিন মনে হয়েছিলো! নরপিশাচ আবু জাহল নির্মম ভাবে বল্লমের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের এই বোনটিকে শহীদ করেছিলো…! গ্রহণযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থসমূহের অন্যতম ‘তাবাকাত ইবন সা’আদ’-এর ভাষ্যমতে, দ্বীনের জন্যে এটিই ছিলো ইতিহাসের প্রথম আত্মত্যাগ।

গল্প কি শুধু গল্পই? না, ভগিনীগণ! ভাবনার কিছু উপাদানও আছে আপনার জন্যে।

আপনারা লক্ষ্য করেছেন, আপনাদের জানাশোনা অনেক সাহাবীর কথাই এখনো আসে নি, তাই না? হ্যাঁ, আমার ঈর্ষার তালিকা আরো দীর্ঘ… পঠন এবং নোট করার ধারাবাহিকতা না থাকায় ঈর্ষার তালিকা এদিক-ওদিক হয়েছে। সেইসব গল্পও শোনাবো ইন শা-আল্লাহ।

যাই হোক, আজ ডায়েরির সেই পাতাটা উল্টিয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার ঈর্ষার প্রথম দশজনের মধ্যে পুরুষ এবং মহিলা সাহাবীর রেশিও হলো ২:৮। আল্লাহর কি ইচ্ছা!!

তারপর ইচ্ছে হোল ভগিনীদেরও একটু জানিয়ে দেয়া যাক্। সে জন্যে কি-বোর্ডে হাত দিলাম…কতটুকু বলতে পেরেছি জানি না, তবে বিশ্বাস করুন, আপনাদের দিকে চেয়ে ‘জাগো ভগিনী!’ উচ্চারণ করেছি খুব দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়েই। কি! পারা যাবে না ভগিনীগণ…?

বিষয়: বিবিধ

১৩৯৩ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

238013
২৩ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫৭
আবু সাইফ লিখেছেন : আমার স্মরণশক্তি খুব দুর্বল ,

তবু মনে হচ্ছে আপনার ব্লগের এখন পর্যন্ত সেরা লেখা এটি

একটানেই পড়েছি,
আবেগাপ্লুত হয়েছি

এখন আপনাকেও হিংসাকরার তালিকায় জুড়ে নিলাম

আল্লাহতায়ালা আপনাকে সকল কল্যানে ভূষিত করুন এবং সেসব চিরস্থায়ী করুন (আমীন)
২৭ জুন ২০১৪ রাত ০৯:১৫
185822
আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খাইরা, প্রিয় আংকল। আল্লাহ আপনার দু'আ কবুল করুন। Good Luck
238028
২৩ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৩
ফেরারী মন লিখেছেন : জাজাকাল্লা খায়র... অনেক ভালো লাগলো পড়ে। আরো বেশী বেশী লিখুন
২৭ জুন ২০১৪ রাত ০৯:১৬
185823
আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব লিখেছেন : ওয়া ইয়্যাক। দু'আ করবেন। Good Luck
238078
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০৯:২৫
জাকির হোসাইন লিখেছেন : অসাধারণ একটা লিখা পড়লাম! আল্লাহকে ধন্যবাদ এরকম একটা লিখা পড়ার তাওফিক দেয়ার জন্য! আর ধন্যবাদ তাকে যার মাধ্যমে এটা সম্ভব হল!
২৭ জুন ২০১৪ রাত ০৯:১৬
185824
আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব লিখেছেন : শুকরান জাযীলা, প্রিয় ভাইয়া। Good Luck
238095
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০৯:৪৯
ভিশু লিখেছেন : একটি বিশেষ ধরনের লেখা!
খুব ভালো লাগ্লো...Happy Good Luck
রমযান-আলোচনায় একটি টপিক নেয়ার জন্য অনুরোধ রইলো!
২৭ জুন ২০১৪ রাত ০৯:১৬
185825
আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব লিখেছেন : অনেক শুকরিয়া ভাইয়া। দু'আ করবেন। Good Luck
238182
২৪ জুন ২০১৪ রাত ০২:১৫
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো পিলাচ
২৭ জুন ২০১৪ রাত ০৯:১৬
185826
আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব লিখেছেন : অশেষ ধন্যবাদ। Good Luck
238193
২৪ জুন ২০১৪ রাত ০৩:৩৮
লেখার আকাশ লিখেছেন : এত আবেগ আর মমতা দিয়ে লিখেছেন যে পড়তে পড়তে অজান্তেই চোখের কোনায় পানি চলে এসেছে। এত লম্বা একটি লেখা অথচ পড়তে কি যে ভাল লাগল! অশেষ শুকরিয়া!
২৭ জুন ২০১৪ রাত ০৯:১৭
185827
আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খাইরা, প্রিয় ভাইয়া। দু'আ করবেন আমার জন্যে। Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File