ডায়েরি

লিখেছেন লিখেছেন কানামাছি ২৯ আগস্ট, ২০১৪, ০৬:২৭:৩৪ সকাল

ইদানিং প্রায়ই মধ্যরাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায় মাহমুদের,একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর ঘুমুতে যায়না মাহমুদ।কিছুক্ষন স্থির হয়ে বসে আনমনে কি যেন ভাবে।তারপর নিঃশব্দে ড্রয়ারের ভেতর জরাজীর্ণ ডায়েরিটা খোঁজ করে। ডায়েরির স্পর্শ অনুভব করা মাত্রই হৃদস্পন্দন কমে যায় ।এরপর নীরবে বারান্দায় চলে যায়। ইজি চেয়ারে বসে একটি একটি করে ডায়েরির পাতা উলটাতে থাকে আর চোখের অশ্রু ফেলে।ফজরের সময় হলে মা যখন ফোন দেয়,তখন ওজু করে মসজিদে যায় সালাত আদায় করার জন্য।গত একমাস ধরে এই কাজ যেন নিত্যকার কাজে পরিণত হয়েছে মাহমুদ সাহেবের।

মাহমুদের দেশের বাড়ি খুলনা। দেশের বাড়ি খুলনা হলেও তার জন্ম ঢাকাতেই । তিন ভাই আর দুই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়।ঢাকাতেই তার পড়াশুনা এবং বেড়ে উঠা।অন্য দুইভাইয়ের মাঝে বড় ভাই মাইনুল ঢাকা টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে এখন একটি বায়িং হাউজে চাকরি করছে,মাইনেও বেশ ভালো।সবার ছোট আরিফ এ বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিল।ভাইবোনের মধ্যে আরিফের মেধাই সবচেয়ে ভালো। যদিও গতানুগতিক পড়াশুনায় সে খুব বেশী আগ্রহী নয়। আর তাইতো ওকে নিয়েই একটু দুশ্চিন্তা পরিবাবের অন্য সবার।

মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেছে। গত বছর GRE(Graduate Record Exam) দিয়ে স্কলারশিপ(T.A-Teacher Assistant) পেয়ে এখন আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে হাইড্রোলোজির উপর।এই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়েরই জগৎবিখ্যাত ছাত্র ছিলেন জন ন্যাশ।যিনি ১৯৯৪ সালে “গেম থিওরির” উপর অর্থনীতিতে জন হার্সান্ইয়ি এবং রাইনহার্ড সেল্টেনের সাথে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।মাহমুদের বড় বোন আয়েশার অল্প বয়সেই বিয়ে হয়,দুই সন্তান লাবিব এবং রেহনুমাকে নিয়ে তার সুখের সংসার।আয়েশার স্বামী আবু সুফিয়ান মুহাম্মাদ(সা)এর দেশ সৌদি আরবে বোরকার দোকানে কাজ করতেন।বেশ কিছু পুঁজি জোগাড় করে দেশে ফিরে নিজেই এখন একটি বোরকার দোকান শুরু করেছেন।নাম দিয়েছে্ন - “রেহনুমা হিজাব”।

আর সবার ছোট বোন মহুয়া ইডেন কলেজে ইতিহাসে পড়ে।দেখতে শুনতে বেশ ভালো।আজিমপুরে একটি হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে।ইদানিং প্রায়ই তার বিয়ের প্রস্তাব আসছে।মহুয়ার অবশ্য সেই দিকে খুব বেশি খেয়াল নেই।পড়াশুনার প্রতিই সে বেশি মনোযোগী।মেঝ ভাইয়ের মত সেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী।

ছেলেবেলা থেকে বইপড়ার প্রতি দারুন ঝোঁক মাহমুদের।একটা বই পড়া শুরু করলে সেটা শেষ না করা পর্যন্ত তার বিশ্রাম নেই। তবে বই পড়ার ক্ষেত্রে মাহমুদ ছোটবেলা থেকেই কিছু দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে, হাতের কাছে কোন বই পেলেই তা গোগ্রাসে গিলে ফেলেনা।মাহমুদের বিশ্বাস “ভালো খাদ্য খেলে যেমন সুন্দর দেহ তৈরি হয় ঠিক তেমনি সুন্দর বই মানুষের সুন্দর একটি মন তৈরি করে”।নিজের জাতীয় ও নৈতিক স্বকীয়তা বজায় থাকে এমন ধরণের বই পড়তে নিজে পছন্দ করে এবং বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদেরও উৎসাহ দেয় পড়তে।

বই পড়তে পড়তে একসময় লিখালিখিও কিছুটা রপ্ত করে ফেলে মাহমুদ। মুহূর্তের মধ্যে কবিতা আর গল্প লিখে ফেলার দারুন প্রতিভার কারনে বন্ধু মহলে “ স্বভাব কবি” হিসেবে ছেলেবেলায় উপাধি পেয়ে যান।কেউ কেউ আবার জুনিয়র গোবিন্দ্র দাস বলে ডাকতে শুরু করে।ফলশ্রুতিতে স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লিটল ম্যাগাজিন আর সাময়িকী প্রকাশের গুরুভার সবসময় তার উপর এসে বর্তাত।কবি হিসেবে ছেলেবেলায় উপাধি পেলেও কবিতা লিখার অভ্যাসটা এখন আর তেমন নেই।ছাপার হরফে তার কোন কবিতা ছাপা না হলেও এই কবিতাই তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।মাহমুদের বয়স একযুগ পূর্তি উপলক্ষে মাহমুদের মামা মাহমুদকে একটা ছোট্ট ডায়েরি উপহার দেন।সেই ডায়েরির পুরোটা জুড়েই স্বরচিত ছড়া আর কবিতা।

মাহমুদের বাবা মিজানুর রহমান ছিলেন পুরোদস্তুর সাহিত্যমনা মানুষ।লিও তলস্তয় থেকে মার্ক টয়েন সবার লেখাই তার পড়া ছিল।মাহমুদের শিল্প সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক তার বাবার কাছ থেকেই পাওয়া ।মিজানুর রহমান ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে চাকরি করতেন। সরকারি চাকরির সামান্য মাইনে দিয়ে পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে তার ঢাকায় থাকা বেশ সংগিন হয়ে গেলে তার সহধর্মিণী তাকে পরামর্শ দেয় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি শেখার জন্য।বছর তিনেক পড়াশুনা আর দূরসম্পর্কের এক চাচাত ভাইয়ের দোকানে কিছুদিন থাকার পর কারওয়ান বাজারে নিজেই একটা দোকান দেন।অফিস শেষ করে বাসায় এসে একটা চা আর কিছু বিস্কুট খেয়েই মাগরিবের নামাজ পরে দোকান খুলতে যেতেন।অমায়িক ব্যবহার ,চারিত্রিক দৃঢ়তা আর সেবাদানকারী মনোভাবের কারনে অল্পদিনেই বেশ পরিচিত হয়ে যান করে তিনি।দুই বেলা ডাল ভাত খেলেও ছেলেমেয়ের পড়াশুনা ঠিকমত চালাতে পেরে মিজান সাহেব সবসময় সৃষ্টিকর্তার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করতেন।যতদিন বেঁচে ছিলেন ছেলেমেয়েদের প্রায়ই বলতেন,“জীবনের সেই কঠিন সময় তোদের মায়ের সেই পরামর্শের জন্যই আজ সব ভাইবোনের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হচ্ছে।এই মাকে কখনো কষ্ট দিবিনা”।

মাহমুদ যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে একদিন হঠাৎ তার বাবার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়।বাসায় ফিরে মহুয়াকে বলেন এক গ্লাস পানি দিতে। কিন্তু মহুয়া পানি আনার পূর্বেই তিনি সবাইকে রেখে চলে যান “না ফেরার দেশে”।জীবনসঙ্গীর এই আকস্মিক বিয়োগে ভেঙ্গে পড়েনা স্ত্রী রোকেয়া বেগম।ধৈর্য ধরে সংসারের হাল ধরেন।মিজানুর রহমানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ইউসুফ মিয়া,তিনিও হোমিও প্যাথিক ডাক্তার ছিলেন।মিজান সাহেবের ইন্তেকালের পর কারওয়ান বাজারের দোকানটি যখন বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল তখন এই ইউসুফ মিয়াই দেবদূতের মত এসে এই বিপদের দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান।একবেলা তার নিজের দোকানে বসতেন আর অন্যবেলা বন্ধুর দোকানে বসতেন।নিজের জন্য সামান্য সম্মানী রেখে বাকিটা মাহমুদের মায়ের হাতে তুলে দিতেন।সত্যিকার বন্ধুর একটা নমুনা পেশ করেন তিনি।কিছুদিন পর এই জান্নাতি মানুষটিও চলে যান না ফেরার দেশে। এর পর যখন মাইনুলের টেক্সটাইল মিলে চাকরি হয় তখন অনেকটা হাল্কা হয়ে যায় সংসারের বোঝা।সুদিন আবার ফিরতে শুরু করে মাহমুদদের কুটিরে।

মাহমুদের জানতোনা যে তার কবিতার সবচেয়ে বড় পাঠক ছিলেন তার বাবা।সন্তানের কবিতার তিনি এতই ভক্ত ছিলেন যে শুধু নিজে পড়ে তৃপ্তি হতেন না ।তাইতো প্রতিদিন অফিসে ডায়েরিটা সঙ্গে নিয়ে যেতেন।কাজের ফাকে সহকর্মীদের আবৃত্তি করে শোনাতেন অপ্রকাশিত কবিতাগুলো।তিনি যেমন ছিলেন সাহিত্যমনা,তেমন ছিলেন সামাজিক।বন্ধু বান্ধবদের প্রায়ই বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন।তার মৃত্যুর পর স্বল্প পরিসরে হলেই বাবার এই অভ্যাসটা চালু রেখেছে তার ছেলেরা।

মৃত্যুর কিছুদিন পর মাহমুদ বাবার অফিসে যায় পেনশনের টাকার কাগজপত্র তুলতে।অফিসের যে টেবিলটায় তিনি প্রতিদিন বসতেন সেই টেবিলটা তখনো খালি পড়ে ছিল।বাবার ব্যবহার করা চশমা আর কিছু প্রয়োজনীও কাজপত্র নেবার জন্য ড্রয়ার খুলতেই চোখে পড়ে তার ছেলেবেলার কবিতা সংকলনের ডায়েরি।অফিসের সহকর্মীরা জানালো, তার বাবা তার কবিতা কত ভালবাসত,প্রতিদিনই আবৃত্তি করে শোনাত তার লিখা কবিতাগুলো।বাবার মৃত্যুর সময় মাহমুদ এক বিন্দুও কাঁদেনি।এবার অবশ্য চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারল না।

দূর দেশে পড়তে এসে ইদানিং বাবার কথা কেন জানি খুব বেশি মনে পড়ছে মাহমুদের।মাঝে মাঝেই দুঃস্বপ্ন দেখেন ডায়েরিটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।আচমকা ঘুম থেকে উঠে পড়েন।হন্তদন্ত হয়ে খোজ করেন ডায়েরির।ডায়েরিটা পাওয়া মাত্রই যেন প্রাণ ফিরে পায় সে।ভুলে যায় না বলা অনেক বেদনার কথা।কারণ এই ডায়েরিতে যে ছড়িয়ে আছে তার বাবার ভালোবাসার পরশ।

বিষয়: Contest_father

১৩৩৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

259336
২৯ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৬:৩৬
এবেলা ওবেলা লিখেছেন : সত্যি করে একটা কথা বলবেন মাহামুদ চরিত্র টা আপনি নিজে কিনা-- লেখা পড়ে মনে হল ---
২৯ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৬:৪৯
203159
কানামাছি লিখেছেন : না।আমার বন্ধু।ধন্যবাদ গল্পটা পড়ার জন্য।
259354
২৯ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:৩৯
কাহাফ লিখেছেন : এমন একটা সুন্দর লেখা উপহার দেয়ায় অনেক ধন্যবাদ ভাই......। ভালো থাকুক প্রিয় জনেরা সবার।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File