পচা পান্তায় লর্ড হেস্টিংস-এর ডিনার। আর দাম? বাংলার স্বাধীনতা !

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ০৫ জুন, ২০১৭, ০৩:১২:৩৪ রাত



ঘটনাটা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হারানোর প্রক্রিয়াকালীন, সেই ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দের। পলাশীর চুড়ান্ত যুদ্ধের মাত্র কয়েক মাস আগেকার ঘটনা। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক নবাব ও তার প্রশাসনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে যথেচ্ছভাবে ব্যবসা পরিচালনা, অস্ত্রসংগ্রহ ও দূর্গ নির্মাণ, কর ফাঁকি দেওয়াসহ অবৈধ ব্যবসা এবং নানান রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনার কারণে নবাব আলীবর্দী খান তাদেরকে বার বার সতর্ক করে দেওয়ার পরেও তারা নবাবের নির্দেশকে আমলে নেয় নি, বরং উল্টো নবাবের মনোনিত উত্তরসূরীর বিরোধিতাকারীদের (মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, রায়বল্লভ গং) সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে, এর মাধ্যমে তারা প্রকারান্তরে স্বাধীন বাংলার রাজনীতিতে নাক গলায়।

এরই মধ্যে তারা কাশীমবাজার কুঠিতে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদের মওজুদও গড়ে তোলে। পরবর্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেয়া তথ্য মতে দেখায় যায় যে, নবাব আলীবর্দী খানের মনোনিত উত্তরসুরী সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজ বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতেন এবং তিনি ক্ষমতায় এলে কোম্পানীর ব্যবসায়ীব স্বার্থ ও ক্ষমতা খর্ব করবেন, এমন খবর তাদের কাছে ছিল, এরকম সংবাদ থাকার কারণেই তারা নবাব সিরাজের ক্ষমতারোহনের বিরোধিতা করার স্বিদ্ধান্ত নেয়।

যাই হোক, ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে নবাব আলীবর্দী খান ইন্তেকাল করেন, সিরাজ বাংলার নবাব হয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া স্বাধীনতাকে সংহত করতে বিদেশি বেনিয়া ইংরেজদেরকে রাষ্ট্রের অনুগত করতে তৎপর হন। কোম্পানীর কাশিমবাজার দূর্গ অবরোধ করেন। বহু ইংরেজ সৈন্য বন্দী হলেও কোম্পানীর পক্ষ থেকে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব ওয়ারেন হেষ্টিংস পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া হেষ্টিংস কুঠির পাশেই একটা মুদির দোকানে আশ্রয় নেয়। উক্ত দোকান মালিক মুদিখানা দোকার করার পাশাপাশি আট টাকা মাসিক বেতনে কোম্পানীর একজন কর্মচারী ছিল, কৃষ্ণকান্ত নন্দী নাম হলেও কান্তুমুদি নামেই সকলেই চিনতো। কোম্পানীর ফুট ফরমায়েশ ভেটে দেবার চাকরী করার কারণে হেষ্টিংসও তাকে চিনতো।

বাংলার নবাব যখন স্বাধীনতা সংহত করতে ব্যস্ত, সেই তখন তারই এক প্রজা, বঙ্গবাসী এই কান্তমুদী হেস্টিংসকে আশ্রয় দিয়ে গোপনে রক্ষা করে। জুলাই আগষ্ট মাসের প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমের সেই দিন প্রাণভয়ে ভীত, ক্ষুধার্ত হেষ্টিংস-এর রাতের ডিনারের আয়োজন করেছিল। ডিনারের মেনু ছিল, রাতের খাবারের পর পরের দিন পান্তা খাবার জন্য ভাতের ভেতরে পানি দিয়ে রাখা ভাত, কাঁচা মরিচ, বড়ি পোড়া আর চিংড়ি মাছের তরকারী, ওগুলোই লবন দিয়ে একটা কলাপাতা কেটে এনে তাতে পরিবেশন করা হয়। হেষ্টিংস গ্রোগ্রাসে ডিনার খেয়ে সেখানেই গরুর গোয়ালে রাত্রি যাপন করে পালিয়ে থেকে।

এর পরে দুটি দশক না যেতেই ১৭৭৪ সাল নাগাদ এই হেষ্টিংস-ই বাংলার নবাব। কান্তমুদির অবাধ যাতায়াত হেষ্টিংস এর দরবারে। এখন সে আর কান্ত মুদি নয়; 'কান্ত বাবু'। বাংলার নবাব হেষ্টিংস এর বিশেষ প্রিয় ভাজন হবার সুবাদে এই মুদি দোকানদার জমিদারী থেকে শুরু করে লবনের ইজারাদারী বাগিয়ে নেয়। রাতারাতি কোটিপতি হয়ে উঠে সে। কাশিমবাজার জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতাও সে! (সুত্র- Warren Hastings in Lower Bengal, Calcutta Review)।

বেনারসের রাজা চৈতসিংহ এবং তার রাণী, মুর্শীদাবাদের মনি বেগম ও অযোধ্যার রাণীদের উপরে অত্যাচার করে বার বার তাদের কাছ থেকে হেস্টিংসর এর জন্য অর্থ আদায় ও তাতে ভাগ বসানোর মাধ্যমে কান্তমুদি হেস্টিংসের জন্য আয়োজন করা সেই ডিনারের দাম উসুল করে নেয়। কান্তমুদি কতটা বিত্তের মালিক হয়েছিল সেটা জানতে ও বুঝতে হলে কেবল এটা জানাই যথেষ্ঠ যে, সে তার মা'র শ্রাদ্ধ করতে সে যুগে প্রায় কুড়ি লাখ টাকা খরচ করেছিল।

সত্যিই, হেস্টিংস-এর জন্য পচা বাসী পান্তা ভাতের ডিনার। আর দাম? বাংলার স্বাধীনতা! একটু বেশিই ছিল বৈকি!!

বিষয়: বিবিধ

১২৯২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383260
০৫ জুন ২০১৭ রাত ০৯:০৩
মনসুর আহামেদ লিখেছেন :
ভালো লাগলো , অনেক ধন্যবাদ
383265
০৬ জুন ২০১৭ রাত ১২:৩৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File