সুন্দরবনে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কিছু কথা(১ম পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন দিগন্তে হাওয়া ১৭ জুলাই, ২০১৬, ০৫:৫৬:০৬ বিকাল



সুন্দরবন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বপ্ন। আমাদের ১৬ কোটি নিঃশ্বাসের উৎস। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এই সুন্দরবন কেন্দ্রীক। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সুন্দরবন ও আশেপাশের খাল, নালা ও নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আমাদের বন্যপ্রাণীর অধিকাংশের আবাসস্থল এই সুন্দরবনে। জাতীয় প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাসও এই সুন্দরবনে। চিত্রা হরিণ, পারা হরিণ, বানর, বনমোরগ, কাঠবিড়ালি, চিতা বাঘ, গণ্ডার ও অসংখ্য প্রজাতির পাখি'র বসবাস এই নয়নাভিরাম বনেই। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ও জীববৈচিত্রের আঁধার ভালোবাসার এই সুন্দরবন। সেই বনের পরিবর্তেই আজ স্থাপন করা হচ্ছে কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র।

যেখান থেকে শুরু এই রামপাল প্রকল্পঃ ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতার হয়। ২০১০ সালের ৩০ আগস্ট এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়।

এরপর রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের(এনটিপিসি) সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড(পিডিবি)।

গত ১২ জুলাই, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি(প্রাইভেট) লিমিটেড(বিআইএফপিসিএল), ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেডের(বিএইচইএল) সঙ্গে বাগেরহাটের রামপালে মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট বাস্তবায়নে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি সই করে। ১.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের এ চুক্তির অর্থায়ন করবে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এ বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

সুত্রঃ দৈনিক যুগান্তরঃ http://bit.ly/29JLMR3

বিডি নিউজঃ http://bangla.bdnews.com/news/1083

সুন্দরবন ও রামপাল প্রকল্পে আমাদের ক্ষতিঃ

আর্থিকভাবে অলাভজনক: ইন্দো-বাংলা যৌথ কম্পানির থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য বাগেরহাটের রামপালে এই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ করা হবে। যার নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই নির্মাণ ব্যয়ের শতকরা ৭০ ভাগ বৈদেশিক ঋণ থেকে ধার করা হবে। বাকী শতকরা ৩০ ভাগ প্রকল্প ব্যয় বাংলাদেশ ও ভারত সমানভাবে অর্থ্যাৎ শতকরা ১৫ ভাগ হারে বহন করবে।

সুত্রঃ দ্যা ইন্ডিপেন্ডেণ্ট থেকেঃ http://bit.ly/29zYanj

 একটি সূত্র বলছে, এনটিপিসি ও পিডিবির যৌথভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ অর্থাৎ তিন হাজার ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয় করবে পিডিবি ও ভারতীয় কোম্পানি অর্থাৎ প্রত্যেকে ১৫% করে বিনিয়োগ করবে।

বাকি ৭০ শতাংশ বা ৯ হাজার ২৪০ কোটি টাকা অর্থায়ন হবে ঋণের মাধ্যমে যা এনটিপিসি(ভারতীয় কোম্পানি) বিভিন্ন ব্যাংক ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে সংগ্রহ করবে।

কাজেই মাত্র ১৫% বিনিয়োগ করেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৮৫% মালিকানাই থাকবে এনটিপিসি(ভারতীয় কোম্পানি)’র।

সুত্রঃ http://bit.ly/29VyYZd

 এই বিষয়ে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন,

এখানে বিদ্যুতকেন্দ্র হলে ভারতের জন্য অনেক লাভজনক হবে। একই সাথে ভারতীয় কোম্পানীকে অনেক ধরনের সুযোগ সুবিধাও দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। তাদের কর মওকুফ করা হচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানী’এনটিপিসি’ শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ ইনভেস্ট করে শতকরা ৫০ ভাগের কর্তৃত্ব পাবে।

তাছাড়া তাদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে। শুধু তাই না যে বিদ্যুত তৈরী হবে তার দাম এখনও অনির্ধারিত। সবকিছু মিলিয়ে ভারতের লাভের অঙ্ক অনেক বেশি।

সুত্রঃ http://bit.ly/29MFbp0

পরবর্তীতে এই প্রকল্প থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সেই বিদ্যুৎ কিনবে ভারতের কাছ থেকে। আর বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে একটা ফর্মুলা অনুসারে।

ফর্মূলার বর্ননাঃ যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা। আর যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১৪৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কয়লার দাম প্রতি টন ১৪৫ ডলার চূড়ান্ত করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ এই প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ কিনতে চায় তবে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা।

অথচ এর আগে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, খুলনার লবণচরা এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারায় যে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে পিডিবি চুক্তি করেছিল, সেখানে পিডিবি মাওয়া থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে ৪ টাকায় এবং আনোয়ারা ও লবণচড়া থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে ৩ টাকা ৮০ পয়সা হিসেবে। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে পিডিবি'র প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা।

২,সুন্দরবনের নিকটেঃ Environmental Impact Assesment(EIA) প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে এবং সরকার নির্ধারিত সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার ইনভায়রনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) থেকে ৪ কিমি বাইরে বলে নিরাপদ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু জিআইএস সফটওয়্যার দিয়ে মেপে দেখা যায়, এই দূরত্ব সর্বনিম্ন ৯ কিলোমিটার হতে সর্বোচ্চ ১৩ কিলোমিটার।



অন্যদিকে যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে সেই ভারতেরই ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী,

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না।

রামপাল প্রকল্পের ভারতীয় কম্পানী এনটিপিসির সম্পর্কে কিছু পুরনো তথ্যঃ ভারতের বিজ্ঞান ও পরিবেশ সেন্টারের ‘হিট অন পাওয়ার’ নামক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বৈশ্বিক মানদণ্ডে ভারতের কয়লা বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর পরিবেশ দূষণ রোধের দক্ষতা উল্লেখযোগ্য ভাবে নিম্নমানের।

তাদের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে আবার নিম্নতর মানের একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এনটিপিসি এবং ভারতেই সবচেয়ে পরিবেশদূষণকারী বদরপুর প্রকল্পটি ছিল এদেরই।

সুত্রঃদৈনিক প্রথম আলোঃ http://bit.ly/29KV9jN

যে কম্পানীকে নিয়ে ৮ অক্টোবর ২০১০ তারিখে ভারতের দ্যা হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত NTPC’s coal-based project in MP turned down বা ‘মধ্যপ্রদেশে এনটিপিসির কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বাতিল’ শীর্ষক খবরে বলা হয়: জনবসতি সম্পন্ন এলাকায় কৃষিজমির উপর তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রহনযোগ্য হতে পারে না বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গ্রীন প্যানেল মধ্যপ্রদেশে ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন(এনটিপিসি) এর ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি।

সুত্রঃ দ্যা হিন্দু পত্রিকা থেকেঃ http://bit.ly/29JgsAW

NTPC’রএকই ধরণের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের প্রস্তাব গাজমারা উড়িষ্যা থেকে পরিবেশ বিভাগ থেকে ছাড়পত্র না দিয়ে ফেরত দেয়া হয়।

সুত্রঃ দ্যা হিন্দু বিজনেস থেকেঃ http://bit.ly/29zYliw

যে বিবেচনায় NTPC নিজের দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রনির্মাণ করতে পারেনি সেই একই বিবেচনায় বাংলাদেশে কী করে তারা এই প্রকল্পের দায়িত্ব পেল ?

চলবে ...

বিষয়: বিবিধ

১৮০৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

374853
১৭ জুলাই ২০১৬ রাত ০৮:১৫
শেখের পোলা লিখেছেন : বাংলাদেশ নাদিয়ে যাবে কোথায়। ওদের কয়লা বেচার বাজার চাই আর বাংলাদেশ তাদের আশ্রিত অঞ্চল। অতএব?
374869
১৮ জুলাই ২০১৬ সকাল ১০:৪৭
নেহায়েৎ লিখেছেন : নাফরমানি করিওনা মিয়ারা,
দাদাদের উপর বিশ্বাস রাখ।
সুন্দরবন দিয়ে কি হইব? যদি ভারতের সাথে বন্ধুত্ব না থাকে?!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File