কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?

লিখেছেন লিখেছেন জীবরাইলের ডানা ১৮ মার্চ, ২০১৮, ০১:৫৩:০৯ রাত

প্রশ্ন : এক ব্যক্তি লিখেছেন : "ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচরাচর শিক্ষকের জন্য দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের রেওয়াজ রয়েছে। এ প্রথাটি নিয়ে সম্প্রতি বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। মিশকাত শরিফে হযরত আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল সা. স্বয়ং সম্মানার্থে দাঁড়ানোর আদেশ দিয়েছেন। হযরত ফাতেমার জন্য তিনি যে দাঁড়াতেন তার প্রমাণ রয়েছে। অপরদিকে তিরমিযী শরিফে বর্ণিত সহীহ হাদিসে প্রমাণ রয়েছে যে, সাহাবাগণ রসূল সা.-এর জন্য দাঁড়াতেন না। হযরত মুয়াবিয়া বর্ণিত হাদিসে কারো জন্য দাঁড়ালে জাহান্নামে যেতে হবে বলে সাবধান করা হয়েছে। হযরত আবু উমামা বর্ণিত হাদিসে এটিকে অনৈসলামিক কাজ আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারো কারো ধারণা, হযরত সা'দের আগমনে রসূল সা. সাহাবাগণকে উঠে দাঁড়ানোর আদেশ দিয়ে যে কথাটি বলেছিলেন, তা -------------------- 'তোমাদের নেতার জন্য উঠে দাঁড়াও' নয় বরং তিনি বলেছিলেন -------------------- 'তোমরা তোমাদের নেতার কাছে উঠে যাও।' কেননা হযরত সা'দ অসুস্থতার জন্য একাকী সওয়ারি জন্তুর পিঠ থেকে নামতে অক্ষম ছিলেন, তাই তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন। সমস্যাটা শুধু মাদরাসার নয় বরং দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই এর সম্মুখিন হতে হয়। তাই এ প্রথাটি শরিয়তের দৃষ্টিতে কেমন এবং এ সংক্রান্ত ইসলামি বিধির আসল তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য কি, তা সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করলে বারবার এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিতর্কের উদ্ভব ঘটবেনা।"

জবাব : এ সমস্যাটা নিয়ে আমাদের এখানে মাঝে মধ্যেই কিছু প্রশ্ন এসে থাকে। আলোচ্য প্রশ্নটিও তারই একটি। তাই প্রশ্নটিকে হুবুহু তুলে দিয়ে তার বিশদ ও তথ্যনির্ভর জবাব দেয়া হচ্ছে।

প্রাচীন ইমামদের মধ্যে 'কিয়াম' তথা সম্মানসূচক দাঁড়ানো নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ এটিকে বৈধ মনে করেন। আবার কেউ কেউ এটি সর্বোতভাবে অবৈধ বলে রায় দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ এ কাজ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বৈধ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবৈধ মনে করেন। প্রত্যেক মতের সপক্ষে যুক্তি প্রমাণাদি রয়েছে। এগুলো প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। নচেৎ এগুলোর ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা চালানো সম্ভব নয়।

যারা একে বৈধ মনে করেন তারা এর সপক্ষে একাধিক হাদিস ও সাহাবায়ে কিরামের দৃষ্টান্ত পেশ করে থাকেন। তন্মধ্যে বুখারি, মুসলিম ও অন্য কতিপয় হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত একটি হাদিস প্রশ্নকর্তা স্বীয় প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন। এতে বর্ণিত হয়েছে, বনু কুরায়যা গোত্রের ইহুদীরা পরাজিত হয়ে যাওয়ার পর হযরত সা'দ বিন মায়াযকে শালিস মেনেছিল। সে মতে রসূল সা, তাঁকে ডেকে পাঠালেন। হযরত সা'দ যখন একটা সওয়ারী জন্তুর আরোহী হয়ে তাঁর দরবারে এলেন, তখন রসূল সা. সমবেত সাহাবামণ্ডলীকে বললেন ---------------- 'ওঠো, তোমাদের নেতার কাছে যাও।'

আবু দাউদ ও অন্য কয়েকটি হাদিস গ্রন্থ থেকে এও জানা যায় যে, রসূল সা. স্বীয় ধাত্রীমাতা ও তার স্বামীকে চাঁদর বিছিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং দুধভ্রাতাকে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ জানান ও তারপর কাছে বসান।

অনুরূপভাবে আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে হাম্বান প্রভৃতি হাদিস গ্রন্থে এই মর্মে একাধিক হাদিস বর্ণিত আছে যে, রসূল সা. যখন হযরত ফাতিমার কাছে যেতেন, তখন ফাতিমা দাঁড়িয়ে তাঁর হাতে চুমু খেতেন এবং তাঁকে সাদরে বসাতেন। অনুরূপভাবে হযরত ফাতিমা এলে রসূল সা. ও তদ্রুপ করতেন।

হযরত ইকরামা রা. সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত আছে যে, মক্কা বিজয়ের পর তিনি এতো দিশেহারা হয়ে পড়লেন যে, দেশ ছেড়ে পালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সমুদ্রের তীরে উপনীত হন এবং একটি নৌকায় চড়ে বসেন। সহসা নৌকাটি দুর্যোগের কবলে পড়লে যাত্রীদের একজন দেবতাদের সাহায্য কামনা করতে বলে। কিন্তু অন্যান্য যাত্রীরা বললো : "এমন কঠিন বিপদে দেবতাদের দ্বারা কাজ হবেনা। তোমরা সবাই শুধু আল্লাহকে ডাকো।" এ কথাটা ইকরামার অন্তরে গভীরভাবে বদ্ধমূল হলো, তিনি ভাবলেন, তাহলে তো মুহাম্মদ সা.-এর ধর্মই সত্য। তিনি অন্য একটি নৌকায় চড়ে ফিরে গিয়ে রসূল সা.-এর দরবারে হাজির হলেন, এ সময়ে রসূল সা. তাঁকে স্বাগত জানাতে উঠে দাঁড়ান।

হযরত আদি বিন হাতেমকেও স্বাগত জানাতেও অনুরূপভাবে রসূল সা.-এর উঠে দাঁড়ানোর উল্লেখ হাদিসে রয়েছে। এ ধরণের দাঁড়ানোকে বৈধ প্রতিপন্ন করে এমন সকল হাদিস এখানে উল্লেখ করতে চাইনা। নচেত এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি হাদিস ও সাহাবাদের রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, বায়হাকীতে হযরত আবু হুরায়রার বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, রসূল সা. মসজিদে থেকে ফিরে এলে সাহাবিগণ তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যেতেন। অনুরূপভাবে হযরত কা'ব ইবনে মালেক ও তাঁর দুই সাথি আলস্যবশত যুদ্ধে যাননি। তাঁদের তওবা কবুল হওয়ার পর হযরত কা'ব রসূল সা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে উপস্থিত জনৈক সাহাবি তাকে স্বাগত জানাতে ও খোশ আমদেদ বলতে উঠে দাঁড়ান। হযরত কা'বের কাছে এই সাহাবির দাঁড়ানোর এতো বড় মহানুভবতা মনে হয়েছিল যে, তিনি তা কোনো দিন ভুলতে পারেননি এবং তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। মোটকথা সম্মানার্থে দাঁড়ানোর বৈধতা প্রতিপন্ন করে এমন হাদিস অনেক রয়েছে।

যারা এই দাঁড়ানোর অবৈধ কিংবা মাকরূহ মনে করেন, তারাও অন্য কয়েকটি হাদিস দ্বারা তাদের মতের যথার্থতা প্রমাণ করে থাকেন। সেগুলো নিম্নরূপ :

সুনানে ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদে আছে যে, রসূল সা. লাঠির উপর ভর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে সাহাবিগণ তাঁর সম্মানার্থে দণ্ডায়মান হন। তখন রসূল সা. বলেন : "এভাবে একে অপরকে স্বাগত জানাতে দাঁড়ানো আজমীদের (অর্থাৎ অমুসলিমদের) রীতি, তোমরা এভাবে দাঁড়াবে না।"

আবু দাউদ ও তিরমিযীতে আরো একটি হাদিস রয়েছে যে, রসূল সা. বলেছেন :

---------------------------------

"যে ব্যক্তি কামনা করে যে লোকেরা তার জন্য দণ্ডায়মান হোক, তার জন্য দোযখ অনিবার্য।"

হযরত আনাস কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস তিরমিযী শরিফে রয়েছে যে, "সাহাবিদের কাছে রসূল সা.-এর চেয়ে প্রিয় কোনো ব্যক্তি ছিলনা। কিন্তু তারা রসূল সা.-কে দেখে দাঁড়াতেন না। কেননা তিনি যে এটা পছন্দ করেননা তা তাঁরা জানতেন।"

হযরত আমীর মুয়াবিয়া সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, একবার তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ও ইবনে সাফওয়ানের সামনে আবির্ভূত হলে তাঁরা উভয়ে অথবা তাঁদের একজন দাঁড়িয়ে যান। মুয়াবিয়া বললেন : বসে যান আমি রসূল সা.-কে বলতে শুনেছি :

------------------------------------------------

"যে ব্যক্তি তাকে দেখে লোকেরা দাঁড়ালে খুশি হয়, সে যেনো দোজখে তার আশ্রয়স্থল বানিয়ে নেয়।"

সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূল সা. রোম পারস্যবাসির আপন সম্রাটদের দেখে দাঁড়ানোর প্রথা অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন।

দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনকে যারা অবৈধ মনে করেন, তারা উল্লেখিত হাদিসগুলোকে তো নিজেদের মতের সপক্ষে উপস্থাপিত করেনই, অধিকন্তু দাঁড়ানোকে বৈধ প্রতিপন্নকারি হাদিসগুলোর এমন ব্যাখ্যা দেন যার ফলে বৈধতা সন্দেহজনক হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, হযরত সা'দ বিন মায়ায সংক্রান্ত হাদিস সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হলো, খন্দক যুদ্ধে আহত হওয়ার কারণে হযরত সা'দের কারো সহায়তা ছাড়া একা একা সওয়ারী জন্তুর পিঠ থেকে নামার সামর্থ ছিলনা। তাই রসূল সা. সাহাবিদেরকে বলেন,তারা যেনো উঠে গিয়ে তাঁকে নামিয়ে আনেন। এ জন্যেই রসূল সা. ---------------- (তোমাদের নেতার জন্যে উঠে দাঁড়াও) না বলে ----------------- (ওঠো, তোমাদের নেতার কাছে যাও) বলেন। এর দ্বারা তার সম্মানার্থে বা তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্যে উঠে দাঁড়াতে বলা বুঝায়না বরং সওয়ারি থেকে নামতে তাকে সাহায্য করতে বলা বুঝায়। কেউ কেউ দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য উদঘাটন করেন। যেমন তাঁরা বলে থাকেন যে, দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য যদি হয় মমত্ব ও সৌজন্য প্রকাশ করা তাহলে তা জায়েয, আর যদি তা হয় আগুন্তুকের বড়ত্ব জাহির করার জন্য তবে তা নাজায়েয। কেউ কেউ বলেন, বসার জন্য জায়গা করে দেয়া ও প্রশস্ততা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দাঁড়ানো জায়েয, অন্যথায় মাকরূহ। কেউ কেউ মনে করেন, সেবা কিংবা মনসন্তুষ্টির জন্য একান্ত জরুরি মনে হলে দাঁড়ানো বৈধ। নচেত তা অবৈধ।

উপরে যা কিছু উল্লেখ করা হলো, মোটামুটিভাবে এগুলোই দাঁড়ানোর বৈধতা ও অবৈধতার পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি প্রমাণ। এখন প্রশ্ন হলো, প্রকৃত ব্যাপার কি? ইসলামের নীতি নির্ধারক রসূল সা.-এর মহান বাণী ও মহৎ দৃষ্টান্তসমূহের আসল প্রতিপাদ্য বিষয় কি? একজন মানুষের জন্য আর একজন মানুষের দাঁড়ানোটাকে কি তিনি নিষিদ্ধ করেছেন বা বৈধ করেছেন? না কি, (নাউজুবিল্লাহ) তার কথা ও কাজে এমন কোনো স্ববিরোধিতা রয়েছে, যার সমন্বয় সাধন করা অসম্ভব?

এর জবাব এই যে, আসলে এ বিষয়ে যেসব হাদিস ও বাস্তব দৃষ্টান্ত বর্ণিত হয়েছে, তাতে আদৌ কোনো বিরোধ ও অসামাঞ্জস্য নেই। প্রত্যেকটির ক্ষেত্রও প্রেক্ষাপট রয়েছে, যার উপর পৃথক পৃথক বিধি প্রযোজ্য হয়ে থাকে। কোনো অবস্থাতেই দাঁড়ানো চলবেনা। কিংবা সর্বাবস্থায় দাঁড়ানো বৈধ এ ধরণের রায় দেয়াতে চরমপন্থী মনোভাবের আভাস পাওয়া যায়। শরিয়তের দাবি এই উভয় চরম বিন্দুর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। সব ক'টি হাদিস যদি গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করা হয়, তাহলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, কারো জন্য মানুষের দাঁড়ানো যদি তার দাপট ও ক্ষমতা মদোন্মত্ততার প্রতীক হয় এবং সেই ব্যক্তি নিজেও কামনা করে যে, লোকেরা তার জন্য দাঁড়াক, তাহলে সে ক্ষেত্রে এ কাজটি হবে নিষিদ্ধ ও অবাঞ্ছিত। অনুরূপভাবে এ কাজটি যদি একপক্ষের তোষামোদী ও নতজানু মনোভাবের পরিচায়ক হয় এবং অপরপক্ষের ঔদ্ধত্য ও অহংকারের ধারক হয়, তাহলেও উভয় পক্ষের জন্য এ কাজ নিন্দনীয় ও সমীচীন হবে। কিন্তু এছাড়া অন্য যেসব ক্ষেত্রে দাঁড়ানো হয়, তাকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ বলে রায় দেয়ার সপক্ষে কোনো বলিষ্ঠ প্রমাণ ও যুক্তি দেখানো সম্ভব নয়। সেই সকল ক্ষেত্রে দাঁড়ানোকে বৈধ বলা যেতে পারে। এমনকি যে ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানো হয়, সে যদি ইসলামি মানদণ্ড ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে এর উপযুক্ত হয়, তবে ক্ষেত্র বিশেষে এই দাঁড়ানো প্রশংসনীয় ও বাঞ্ছিত কাজ বলে গণ্য হবে। এটা একটা ভারসাম্যপূর্ণ ও অগ্রাধিকারযোগ্য নীতি। একাধিক ইমাম ও ফকীহ এই নীতি অবলম্বন করেছেন। আবু দাউদের টীকা গ্রন্থ "মায়ালিমুস সুনানে" ইমাম খাত্তাবী র. বলেন :

"একজন জ্ঞানীগুণী নেতা ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের জন্য তার অনুসারী ও অনুগতদের দাঁড়ানো এবং একজন ইসলামি বিদ্বানের জন্য শিক্ষার্থীর দাঁড়ানো মাকরূহ নয় বরং মুস্তাহাব। এ কাজ মাকরূহ কেবল সেই ব্যক্তির বেলায়, যার মধ্যে এসব গুণগরিমা ও বৈশিষ্ট অনুপস্থিত।"

আবু দাউদের সংক্ষিপ্তসার টীকায় হাফেজ মুনযিরী ইমাম খাত্তাবীর এই উক্তিটি নিজের বক্তব্যের সমর্থনে উদ্ধৃত করেছেন যে, অহংকার ও ঔদ্ধত্যের বসে জনগণকে দাঁড়ানোর আদেশ দেয়া এবং এটাকে তাদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেয়া অবৈধ। অন্যথায় অধিকাংশ শরিয়ত বিশেষজ্ঞের মতে ন্যায়পরায়ণ লোকদের জন্য দাঁড়ানো মাকরূহ নয়। ইমাম বুখারি ও ইমাম নববীর অভিমতও অনুরূপ। এমনকি ইমাম নববী দাঁড়ানোকে বৈধ প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় একখানা স্বতন্ত্র পুস্তিকা লিখেছেন। হানাফি ফেকাহবেত্তাদেরও অভিমত এই যে, যে ব্যক্তি সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র, তার সম্মানার্থে দাঁড়ানো জায়েয।

যেসব হাদিস দাঁড়ানোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তার অধিকাংশই দাঁড়ানোর এমন সব অন্তর্নিহিত দোষ, বাহ্যিক আকৃতি ও ভঙ্গিমার উল্লেখ রয়েছে, যার দরুণ ঐ কাজ সত্যিই আপত্তিকর ও অননমোদনযোগ্য হয়ে পড়ে। এই সব দোষের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো, মানুষের মধ্যে মানসিক গোলামী ও হীনমন্যতা সৃষ্টির প্রয়াস, নিজের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার মানসিকতা এবং নিজের দোর্দণ্ড প্রতাপ ও প্রভৃত্বের জোয়াল চাপিয়ে দেয়ার কুমতলবে এই প্রথাকে বাধ্যতামূলকভাবে চালু রাখার প্রবণতা। এক প্রতাপশালী ব্যক্তি ক্ষমতার মসনদে আসীন থাকবেন, আর সকলে তার সামনে হাত জোড় করে, নতজানু হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবে- এ ভাবধারাটা নি:সন্দেহে দাসত্বের পর্যায়ে পড়ে এবং "এক আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্য করা" বলে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার পরিপন্থী। এ জন্যই হাদিসে যে ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও তার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, তার ক্ষেত্রে এরূপ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যে,

----------------------------------------

"যে ব্যক্তি কামনা করে যে জনগণ তার জন্য দলবদ্ধ হয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকুক।"

কোনো কোনো হাদিসে ------------- এর পরিবর্তে ---------------- এর ------------ এর পরিবর্তে -------------- শব্দ এসেছে। এরও অর্থ এই যে, লোকেরা তার জন্য দাঁড়াতে দাঁড়াতে অতিষ্ঠ হয়ে যায় এবং তাদের পা ক্লান্ত হয়ে যায়, যার দরুন তারা পশুর মতো এক পা উঠিয়ে ক্লান্তি দুর করার চেষ্টা করে। কোনো কোনো হাদিসে বলা হয়েছে যে, ------------------------------ অর্থাৎ লোকেরা তার সামনে মূর্তির মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।

যারা হযরত সা'দ বিন মায়ায সংক্রান্ত হাদিসের এরূপ ব্যাখ্যা করেছেন যে, রসূল সা. শুধু তাকে সওয়ারী জন্তুর পিঠ থেকে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এজন্য ---------------- এবং ------------------ এর শাব্দিক হেরফেরকে ভিত্তি করে যুক্তি দাঁড় করেছেন, তাদের যুক্তি তেমন বলিষ্ঠ নয়। ধরে নিলাম যে, হযরত সা'দ যুদ্ধাহত ও অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তিনি তো মদিনা থেকে বনু কুরায়যার এলাকা পর্যন্ত গাধার পিঠে আরোহণ করে পৌঁছে গিয়েছিলেন। গাধার পিঠ থেকে নামা তার জন্য বোধহয় এতো অসাধ্য ছিলনা যে, তার জন্য লোকদের সহায়তা গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। অত:পর তিনি যখন সামনের দিক থেকে আগমন করলেন তখন, রসূল সা. তাঁকে নাম ধরে ডাকার পরিবর্তে ----------- (তোমাদের নেতা) বা --------------- (তোমাদের মধ্যে মহৎ ব্যক্তি) শব্দ বা উপাধি ব্যবহার করলেন। এ দ্বারা তিনি অত্যন্ত জোরালো ইঙ্গিত দিয়ে সাহাবিগণকে বলতে চেয়েছিলেন, ইনি তোমাদের একজন অতীব সম্মানিত ও মর্যাদাবান নেতা যিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারে সালিশ ও বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে আসছেন। তাই তোমরা এগিয়ে গিয়ে তাকে স্বাগত জানাও বরণ করে নাও, যাতে ইহুদীরা এরূপ ধারণা করার সুযোগ না পায় যে, তোমরা মান্যগণ্য ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের মর্যাদা দাওনা। এ ঘটনা সংক্রান্ত কয়েকটি বর্ণনায় রসূল সা.-এর উক্তি ---------- (নামিয়ে আনো) উদ্ধৃত হয়েছে। আর যথারীতি কোনো কোনো টীকাকার এর এরূপ মর্মই গ্রহণ করেছেন যে, "সা'দ বিন মায়াযকে ধরে সওয়ারী থেকে নামাও।"

অথচ এ শব্দটিরও বিশুদ্ধতর তাৎপর্য সাদরে ও সসম্মানে অভ্যর্থনা জানানো। অন্য একটি হাদিসে আছে ---------------- "লোকদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে বরণ করে নাও।" এ হাদিসটিও উল্লেখিত ব্যাখ্যার যথার্থতা প্রতিপন্ন করে।

---------- এবং ---------- শব্দদ্বয়ের অর্থে যে তারতম্য করা হয়েছে, অভিধানের বিচারে সেটাও ধরাবাধা ও অপরিহার্য কোনো ব্যাপার নয়। ---------- প্রবচনটি শুধু কোনো বিপন্ন ব্যক্তিকে উদ্ধার করা বা তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া অর্থেই ব্যবহৃত হয় তা নয়। বরঞ্চ নিছক প্রীতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ কিংবা স্বাগত অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়ানো বা এগিয়ে যাওয়া অর্থেও ব্যবহৃত হয়। শেষোক্ত অর্থে ------------ প্রবচনের ব্যবহার সমধিক প্রচলিত হলেও --------- প্রবচনটির ব্যবহারও প্রচলিত আছে। হাদিসেই এর বহু উদাহরণ পাওয়া যায়।

তিরমিযী শরিফে বর্ণিত আছে যে, হযরত যায়েদ বিন হারেসা মদিনা পৌঁছে রসূল সা.-এর কক্ষের দরজায় করাঘাত করলেন। এরপর মূল হাদিসটির বিবরণ এরূপ :

------------------------------------------------------------

"রসূল সা. তৎক্ষণাৎ নিজের চাদর টানতে টানতে উঠে তার কাছে ছুটে গেলেন, তার সাথে কোলাকুলি করলেন ও তাকে চুমু খেলেন।"

এখানে সুস্পষ্টতই সাহায্য করা বা উদ্ধার করার কোনো ব্যাপার ছিলনা, যেমনটি হযরত সা'দের বেলায় ধারণা করা হয়েছে। এখানে শুধু উচ্চ আবেগোদ্দীপ্ত অভ্যর্থনা ব্যক্ত করার জন্যই শব্দটির প্রয়োগ হয়েছে।

আবু দাউদ ও ইবনে মাজার উদ্ধৃত আবু উমামার বর্ণিত একটি হাদিসের কথা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। ঐ হাদিসের ভাষা এরূপ :

-----------------------------------------------------------

"রসূল সা. আমাদের কাছে এলো পরে আমরা তার কাছে উঠে গেলাম।"

এখানেও একই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে রসূল সা. ও হযরত ফাতেমার পরস্পরকে দেখে উঠে দাঁড়ানো সংক্রান্ত যে হাদিস উপরে আলোচিত হয়েছে, তাতেও হযরত আয়েশার ভাষা আবু দাউদে নিম্নরূপ উদ্ধৃত হয়েছে?

-------------------------------------------------------------

"যখনই হযরত ফাতেমা রসূল সা.-এর কাছে যেতেন, তিনি তার জন্য উঠে দাঁড়াতেন আর যখন রসূল সা. হযরত ফাতেমার কাছে যেতেন, ফাতেমা তাঁর জন্য উঠে দাঁড়াতেন।" এখানেও উভয় স্থানেই ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ এই উঠে দাঁড়ানোটিকে যে একান্ত স্নেহ ও ভক্তির বশেই হতো, তা বলাই বাহুল্য।

এই বিশদ আলোচনার পর আর একটিমাত্র প্রশ্নের মীমাংসা বাকি থাকে। সেটি হলো, দাঁড়ানো যদি শুধুমাত্র একপক্ষের দাসসূলভ বিনয় এবং অপর পক্ষের প্রভূসূলভ ঔদ্ধত্য ও অহংকার যেখানে বিদ্যমান সেখানেই নিষিদ্ধ হয় তাহলে, রসূল সা. নিজের বেলায় সেটা কেনো পছন্দ করেননি? তাঁর এবং সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তো এ ধরনের মনোভাব বিরাজ করার কথা কল্পনাও করা যায়না।

এ প্রশ্নের একাধিক জবাব থাকতে পারে। তবে দীর্ঘসূত্রিতা এড়ানোর জন্য শুধু একটি জবাব দেয়াই যথেষ্ট মনে করছি। সেটি হলো, সাহাবায়ে কেরামের দন্ডায়মান হওয়াকে রসূল সা. হারাম ও অবৈধ মনে করে অপছন্দ করতেননা। নিছক স্বভাবসূলভ ও অভ্যাসগতভাবে তিনি এর প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করতেন। আর সাহাবায়ে কেরাম যেহেতু তার অসন্তোষের উদ্রেক করে এমন নগণ্যতম কাজও করতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাই সচরাচর তাঁর জন্য দাঁড়াতেননা। রসূল সা.-এর ব্যক্তিগত আচরণ ও চালচলনের এমন অনেক দিক রয়েছে, যেখানে তিনি কোনো পন্থা গ্রহণ বা বর্জন করেছেন। এগুলোকে তাঁর ব্যক্তিগত সহজাত গুণাবলীর মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু উম্মতের জন্য সেগুলোকে আদেশ বা নিষেধ বলে মনে করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ রসূল সা. পথ চলার সময় অন্যদের আগে থাকতে চাইতেননা। এর দ্বারা শরিয়তের কোনো বিধি প্রণীত হয়না, যদিও এতে বিনয় ও সরলতার ভাব বিদ্যমান। কাউকে দেখে দন্ডায়মান হওয়ার ব্যাপারটাও তদ্রুপ। তিনি এ কথা কখনো বলেননি যে আমার জন্য দাঁড়ান হারাম বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে কিভাবে ও কোন্‌ মনোভাব নিয়ে তা হারাম করা যায়, সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া কোনো কোনো পরিস্থিতিতে দাঁড়ানোকে নিজের জন্য সহ্যও করেছেন এবং অপরের জন্য পছন্দও করেছেন, এমনকি উৎসাহিতও করেছেন। যাতে এ কাজটি সম্পূর্ণরূপে হারামে পরিগণিত না হয়। আসল ব্যাপার এই যে, ইসলামে জ্ঞানীগুণী ও গুরুজনের প্রতি সম্মান, প্রবীনদের প্রতি আদর ও শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ ও মমত্ব প্রদর্শনের যে নীতিগত ও সাধারণ বিধিমালা দেয়া হয়েছে, তার আলোকে স্বতস্ফূর্তভাবে দাঁড়িয়ে যে আদর, শ্রদ্ধা ও মমত্ব প্রকাশ করা হয়, সেটা ইসলামে নিষিদ্ধ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। [তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৬৮]

বিষয়: বিবিধ

৭৯৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384926
১৮ মার্চ ২০১৮ সন্ধ্যা ০৬:৫৮
শেখের পোলা লিখেছেন : চমৎকার। ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File