ওয়াজ মাহফিল নাকি বিনোদনের আখড়া? সুবক্তার বৈশিষ্ট্য

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:৪৫:৩৬ রাত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

#মানুষকে_আল্লাহর_পথে_ডাকা:

আল্লাহ বলেন-

“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কার্য থেকে নিষেধ করবে। আর এ সকল লোকই হবে সফলকাম।” (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)



#রসনাকে_সংযত_রাখুন: একজন মুসলমান কখনো লাগামহীন (যা খুশি তা) কথা-বার্তা বলতে পারে না, বিশেষ করে যারা সমাজের নেতৃস্থানীয় ও জ্ঞানী। যারা মানুষকে দ্বীনের দিকে আহ্বান করে ও ইসলামী জ্ঞান প্রসারের কাজ করে।

অথচ বর্তমান সমাজে আমরা দেখতে পাই ইসলামী সম্মেলন বা ওয়াজ মাহফিলের নামে বক্তারা লাগামহীন কথা-বার্তা বলে চলেছেন। মুসলিম সমাজে ফিতনা, ফাসাদ, বিদ্বেষ ও অশ্লীলতা ছড়াচ্ছেন। পরস্পরে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্তে ফেলে দিচ্ছেন আর বিশৃঙ্খলা করে ঐক্যের পরিবর্তে দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। এতে মুসলমানদের মাঝে হিংসাত্মক মনোভাব তৈরি হচ্ছে আর বিধর্মীরা ইসলামের সৌন্দর্যের পরিবর্তে সন্দেহে পতিত হচ্ছে।

যেখানে মাহফিলে বক্তা তথা আলেমরা ইসলামের সৌন্দর্য ও কার্যকারীতা তুলে ধরে মুসলমানদের মাঝে একতা ও বিধর্মীদের মাঝে ইসলাম গ্রহণকে তরান্বিত করবেন সেখানে তারা নিজেরাই ফিতনায় জড়িয়ে পড়ছেন। অনর্থক, আজেবাজে ও চটুল রসাত্মক ধরণের কথা বলে জনতাকে হাসানো হচ্ছে। বিশেষ করে অপরকে হেয় বা তুচ্ছ-তাচ্ছ্বিল্য করে মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করা হয় এসব মাহফিলে।

বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের নামে চলছে সুর বেসুরে নানা কিচ্ছা-কাহিনি, কৌতুক, গান, রম্য কথা, হাসি-তামাশা, পরচর্যা আর বিদ্বেষ ছড়ানোর মহা উৎসব। ওয়াজে নেই গাম্ভীর্যতা ও তাকওয়া। আছে শুধু বিনোদন।

আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ লজ্জা ও রসনা সংযত রাখা ঈমানের দু’টো শাখা। পক্ষান্তরে অশ্লীলতা ও বাচালতা (অপ্রয়োজনীয় কথা বলা) মুনাফিক্বীর দু’টো শাখা। (তিরমিযী: ২০২৭, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শাইবাহ্ :১১৮, মুসনাদে আহমাদ ২২৩১২, আল মুসতাদরাক: ১৭, ১৭০; শু‘আবুল ঈমান: ৭৭০৬, সহীহুল জামি‘: ৩২০১, মিশকাত:৪৭৯৬)

হাদীস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন: “আল-আয়্যু অর্থ স্বল্পবাক 'আল-বাযা-য়ু অর্থ অশ্লীল ও নির্লজ্জবাক, আল-বায়ান অর্থ বাকপটু, বাক্যবাগীশ। যেমন পেশাধারী বক্তারা লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়, কথার বন্যা ছুটিয়ে দেয় এবং বাকপটুতার আশ্রয় নিয়ে মানুষের এমন সব প্রশংসা করতে থাকে, যা আল্লাহ তা'আলা মোটেই পছন্দ করেন না।

আল্লাহ বলেন-

"মানুষের মধ্যে এমনও লোক আছে, যার পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে মুগ্ধ করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে, কিন্তু আসলে সে অত্যন্ত ঝগড়াটে লোক"।(সূরাহ ২ বাক্বারা:২০৪)



আবূ সা‘লাবাহ্ আল খুশানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়তম ও আমার সবচেয়ে নিকটতম সেই ব্যক্তি হবে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে চরিত্রবান। আর আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ও সবচেয়ে দূরতম সে ব্যক্তি হবে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে চরিত্রহীন, বেশি কথা বলে, অসতর্কভাবে যা-তা বলে এবং কথাবার্তায় নিজেকে বড় বলে প্রকাশ করে। (আহমাদ: ১৭৭৩২, সহীহ ইবনু হিব্বান: ৫৫৫৭, মুসান্নাফ ইবনু আবূ শাইবাহ্ : ২৫৩২০,মিশকাত:৪৭৯৭)



ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন: ‘আস-সারসার যে লোক বেশি কথা বলে (বাচাল)। আল-মুতাশাদিক' , মানুষের সামনে যে লোক লম্বা লম্বা কথা বলে বেড়ায়, ধৃষ্টতাপূর্ণ ও অশালীন উক্তি করে, নির্লজ্জ ও দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলে। (দ্রষ্টব্য, তিরমিযী: ২০১৮)

#বাকপটুতার_পরিণতি:

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সেসব লোককে ঘৃণা করেন, যে বাকশৈলী ও বাক-নিপুণতা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজের জিহবাকে এমনভাবে নাড়াচাড়া করে, যেভাবে গাভী নিজের জিহবা নাড়াচাড়া করে। (তিরমিযী: ২৮৫৩, আবূ দাঊদ: ৫০০৫, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্: ৮৭৮)


আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মি‘রাজের রাতে আমার গমন এমন একদল লোকের নিকট দিয়ে হলো, যাদের জিহবা আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল। আমি জিবরীল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরীল! এরা কারা? জিবরীল (আ.) বললেনঃ এরা আপনার উম্মাতের মধ্যে ধর্মোপদেশদাতাগণ, যারা এমন কথা বলত, যার উপর তারা নিজেরা ‘আমল করত না। (আহমাদ ১২৪৪৫, মুসনাদে আবূ ইয়া‘লা: ৩৯৯২,মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ: ৫৫০০,মিশকাত:৪৮০১)

#ঠাট্টা_বিদ্রুপ_ও_লোকহাসানো_বক্তৃতা:

ইসলামী শরীয়াতে হাস্য-রসাত্মক কথা বলা বা কৌতুক করা বৈধ হলেও তা হতে হবে সত্য কথা বা ঘটনা। কখনো মিথ্যা কথা দ্বারা বা কাউকে হেয় বা কটাক্ষ করে লোক হাসানো হারাম। (সূরা ৪৯ হুজুরাত:১১)

উমার ইবনু ‘আবদুল ‘আযীয (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘তোমরা ঠাট্টা ও কৌতুক থেকে সাবধান থাক, কেননা তা হলো নির্বুদ্ধিতা, যা বিদ্বেষ ও শত্রুতা ছড়িয়ে দেয়'।

ঠাট্টা ও কৌতুক করার সময় সামান্য পরিমাণেও দীনকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা যাবে না। কারণ এটি হলো ইসলাম ভঙ্গের কারণ। মহান আল্লাহ বলেনঃ

‘‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা জোর দিয়েই বলবে, ‘আমরা হাস্য রস আর খেল-তামাশা করছিলাম।’ বলুন, ‘আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রসূলকে নিয়ে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে?’ ওযর পেশের চেষ্টা করো না, ঈমান আনার পর তোমরা কুফরী করেছ...।’’ (সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্ ৯ : ৬৫-৬৬)



ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ্ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘‘মহান আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রসূলকে নিয়ে ঠাট্টাকারী ব্যক্তি ঈমান আনার পরে কাফির হয়ে যায়।’’

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু উসায়মীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ রব, রিসলাত, ওয়াহী ও দীনের কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা ও কৌতুক করা হারাম। ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা বা কাউকে হাসানোর জন্য এরূপ কাজ করা কারো জন্যে বৈধ নয়। যদি কেউ এরূপ করে তবে সে কাফির।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তাকে জুলুম করবে না। তাকে লাঞ্ছিত ও তুচ্ছ মনে করবে না। তাকওয়া এখানে থাকে। এ বলে তিনি তার বুকের দিকে তিনবার ইশারা করলেন। কোন লোকের খারাপ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করবে। প্রত্যেক মুসলিম একে অন্যের উপর হারাম, তার রক্ত, তার সম্পদ ও তার সম্মান হরণ করা। (মুসলিম:২৫৬৪)



আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা একটি কথা বলে এজন্য যে, সে এটা দ্বারা লোক হাসাবে। সে এ কথার দরুন জাহান্নামের মধ্যে এত দূরে নিক্ষিপ্ত হবে যা আকাশমণ্ডলী ও জমিনের দূরত্বের সমান। বান্দার পা পিছলানোর তুলনায় মুখ পিছলানো ভয়ানক ক্ষতিকর।(মিশকাত:৪৮৩৫)



‘‘বান্দা একটি কথা বলে’’ এ বাক্যে ‘কথা’ বলতে মিথ্যা কথা উদ্দেশ্য, অর্থাৎ মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা অথবা অশ্লীল কিংবা অনর্থক কথা বলে থাকে। এ কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে এবং সে জাহান্নামের এত গভীর পতিত হবে যে, তার গভীরতা আকাশ পাতালের দূরত্বের সমান হবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)

#গালমন্দ_করা_ফাসেকী:

আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিমদের গালাগালি করা ফাসিক্বী এবং খুনাখুনি করা কুফরী। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত:৪৮১৪)


আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে কাফির বলবে, তাদের দু’জনের একজন এর উপযুক্ত সাব্যস্ত হবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত: ৪৮১৫)



আনাস ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি দু’ ব্যক্তি পরস্পরকে গালি দেয়, তবে গালমন্দের পাপ সে ব্যক্তির হবে যে ব্যক্তি প্রথম গালি দিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না অত্যাচারিত ব্যক্তি সীমা অতিরিক্ত করবে। (মুসলিম:৬৮, মিশকাত:৪৮১৮)



#চোগলখুরী ও কপটতা:

আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কিয়ামতের দিন সবচেয়ে খারাপ লোক তাকে পাবে, যে দ্বিমুখী (কপট)। সে এক মুখ নিয়ে এদের কাছে যায় এবং অপর মুখ নিয়ে ওদের কাছে যায়। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত: ৪৮২২)


#গীবত:

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? সাহাবীগণ বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার মুসলিম ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা তার কাছে খারাপ লাগবে। জিজ্ঞেস করা হলো, যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সে ত্রুটি বিদ্যমান থাকে, তুমি যে দোষ-ত্রুটির কথা বললে, তার মধ্যে সে দোষ-ত্রুটি থাকলেই তো তুমি গীবত করলে। আর যদি দোষ-ত্রুটি বর্তমান না থাকে, তবে তুমি ‘‘বুহতান’’ (মিথ্যারোপ) করলে। (মুসলিম)

অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, যদি তুমি তোমার ভাইয়ের এমন দোষের কথা বলো, যা তার মধ্যে রয়েছে, তবে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার সম্পর্কে এমন দোষের কথা বলো, যা তার মধ্যে নেই, তবে তুমি তার প্রতি ‘‘বুহতান’’ (মিথ্যা অপবাদ) দিলে। (দ্রষ্টব্য: মিশকাত:৪৮২৮)

নিকৃষ্ট_বক্তা:

আবদুর রহমান ইবনু গানম ও আসমা বিনতু ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যাদেরকে দেখলে আল্লাহকে স্মরণ হয়। আর আল্লাহ তা‘আলার নিকৃষ্ট বান্দা তারা, যারা মানুষের পরোক্ষ নিন্দা করে বেড়ায়, বন্ধুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং পূত-পবিত্র লোকেদের পদস্খলন প্রত্যাশা করে। (আহমাদ: ১৭৯৯৮, শু‘আবুল ঈমান লিল বায়হাক্বী: ৬৭০৮, মুসনাদুল বাযযার: ২৭১৯, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্: ২৮৮৯)

বক্তার গুণাবলী:

আল্লাহ বলেন-

আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম যে আল্লাহর দিকে আহবান জানায় এবং সৎকাজ করে। আর বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত। আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট; ফলে আপনার ও যার মধ্যে শক্ৰতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। (সূরা ৪১ হা-মীম সাজদাহ:৩৩-৩৪)



সত্যবাদী হওয়া:

"হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও"। (সূরা ৯ তাওবা:১১৯)


ধৈর্যশীল হওয়া:

মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয়। আর উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের। (সূরা ১০৩ আসর: ২-৩)

মার্জিত হওয়া:

আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজন পূর্ণ মু’মিন তিরস্কার ও অভিসম্পাতকারী এবং অশ্লীল গালমন্দকারী ও অহঙ্কারী হতে পারে না। (তিরমিযী: ১৯৭৭, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্: ৩২০)

মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া:

আবূ রুক্বাইয়াহ তামীম ইবনু আওস আদ-দারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘দ্বীন হল কল্যাণ কামনা করার নাম।’’ আমরা বললাম, ‘কার জন্য?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিমদের শাসকদের জন্য এবং মুসলিম জনসাধারণের জন্য। (মুসলিম:৫৫)

ক্ষমাশীল হওয়া: কখনো কারো কাছ থেকে কটু কথা বা কষ্ট পেলেও তাকে হেয় না করে ক্ষমা করে দেয়া জ্ঞানীর লক্ষণ। আল্লাহ বলেন-

“তুমি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করো, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খদেরকে এড়িয়ে চলো” (সূরা আ'রাফ ১৯৯ আয়াত)



#কথা_কাজে_মিল_থাকা:

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা কেন বল? তোমরা যা কর না তোমাদের তা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই অসন্তোষজনক। (সূরা ৬১ সাফ:২-৩)

বাক_সংযম:

আল্লাহ বলেন-

"যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হইয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে"। (সূরা বনী ইসরাইল: ৩৬) তিনি আরো বলেন-

"মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে (তা লিপিবদ্ধ করার জন্য) তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে"। (সূরা ক্বাফ: ১৮)

#অর্থহীন_কথা_বর্জনীয়

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা। (তিরমিযী: ২৩১৭, ইবনে মাজাহ: ৩৯৭৬, মু'জামুল আওসাত:৩৬১)

একজন বক্তা হবে সুভাষী ও বাকসংযমী। যে কথায় উপকার আছে বলে স্পষ্ট হয়, সে কথা ছাড়া অন্য সব (অসঙ্গত) কথা হতে নিজ জিহ্বাকে সংযত রাখা প্রত্যেক ভারপ্রাপ্ত মুসলিম ব্যক্তির উচিত। যেখানে কথা বলা ও চুপ থাকা দুটোই সমান, সেখানে চুপ থাকাটাই সুন্নত। কেননা, বৈধ কথাবার্তাও অনেক সময় হারাম অথবা মাকরূহ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন যে, “মানুষ চিন্তা-ভাবনা না করে এমন কথাবার্তা বলে ফেলে, যার দ্বারা তার পদস্খলন ঘ’টে পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যবর্তী দূরত্ব থেকে বেশি দূরত্ব দোযখে গিয়ে পতিত হয়।”(বুখারী: ৬৪৭৭, ৬৪৭৮, মুসলিম: ২৯৮৮)

#কথা_বলুন_যাচাই_করে:

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শোনে [বিনা বিচারে] তা-ই বর্ণনা করে।’’ (মুসলিম:৫)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক এমন কথাও বলে যে প্রসঙ্গে সে মনে করে যে, তাতে কোন অসুবিধা নেই, এইজন্য সে সত্তরবছর জাহান্নামে অবস্থান করবে। (তিরমিযী: ২৩১৪)

#কঠোরতা ও বাড়াবাড়ি থেকে সতর্কতা:

আল্লাহ বলেন-

“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য কঠিনতা তাঁর কাম্য নয়।” (সূরা বাক্বারাহ: ১৮৫)

عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:هَلَكَ الْمُتَنَطِّعُونَ. قَالَهَا ثَلَاثً

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ চরমপন্থীরা (কথায় ও কাজে কঠোরতা অবলম্বনকারীরা) ধ্বংস হয়েছে, তিনি এ কথা তিনবার বললেন। (সহীহ মুসলিম:২৬৭০,সহীহুল জামি‘: ৭০৩৯)

* চরমপন্থী অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়িকারী এবং কথায় ও কাজে সীমালঙ্ঘনকারী। কথার সীমালঙ্ঘন হলো অনর্থক কথাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। কাজের সীমালঙ্ঘন হলো দীন গর্হিত কোন কাজকে সুন্দরভাবে উদযাপন করা। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; শারহুন নাবাবী হা: ২৬৭০/৭)

আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। যে ব্যক্তি অহেতুক দ্বীনকে কঠিন বানাবে, তার উপর দ্বীন জয়ী হয়ে যাবে। (অর্থাৎ মানুষ পরাজিত হয়ে আমল ছেড়ে দিবে।) সুতরাং তোমরা সোজা পথে থাক এবং (ইবাদতে) মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। তোমরা সুসংবাদ নাও। আর সকাল-সন্ধ্যা ও রাতের কিছু অংশে ইবাদত করার মাধ্যমে সাহায্য নাও।’’ (বুখারী: ৩৯, ৫৬৭৩, ৬৪৬৩, মুসলিম: ২৮১৬)

#সন্দেহজনক বিষয় ও মিথ্যাকে বর্জন:

আবূ মুহাম্মাদ হাসান ইবনু আলী ইবনু আবী ত্বালেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এই শব্দগুলি স্মরণ রেখেছি যে, ‘‘তুমি ঐ জিনিস পরিত্যাগ কর, যে জিনিস তোমাকে সন্দেহে ফেলে এবং তা গ্রহণ কর যাতে তোমার সন্দেহ নেই। কেননা, সত্য প্রশান্তির কারণ এবং মিথ্যা সন্দেহের কারণ।’’ (তিরমিযী: ২৫১৮, নাসায়ী: ৫৭১১, আহমাদ: ২৭৮১৯, দারেমী: ২৫৩২)

#মিথ্যা_বলা_হারাম

বাহয ইবনু হাকীম (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন, তিনি (দাদা) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ধ্বংস তাদের জন্য, যারা কথা বলে আর জনতাকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। তার ওপর ধ্বংস, তার ওপর ধ্বংস। (আহমাদ, তিরমিযী:২৩১৫, আবূ দাঊদ:৪৯৯০, মিশকাত:৪৮৩৪)

কম হাসা: বেশি বেশি হাসি তামাশা করাও ভালো নয়। এ বিষয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
‘তোমরা বেশি বেশি হাসিও না, কারণ অতিরিক্ত হাসি অন্তরকে মেরে ফেলে।’ (সহীহুল জামি‘ ৭৪৩৫)


#বক্তৃতার_মূলনীতি

১.#প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশ:

আল্লাহ বলেন-

“তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা।” (সূরা নাহল: ১২৫) এখানে ইসলাম প্রচার ও তাবলীগের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। বক্তৃতা দিতে হবে প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।

অর্থাৎ, তা হবে হিকমত, সদুপদেশ ও নম্রতার উপর ভিত্তিশীল এবং আলোচনার সময় সদ্ভাব বজায় রাখা, কঠোরতা পরিহার করা ও নম্রতার পথ অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।

মুফাসসির হেকমতের অর্থ নিয়েছেন কুরআন, কেউ কেউ বলেছেন, কুরআন ও সুন্নাহ। [তাবারী] আবার কেউ কেউ অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ স্থির করেছেন। [ফাতহুল কাদীর] আবার কোন কোন মুফাসসিরের মতে বিশুদ্ধ ও মজবুত সহীহ কথাকে হেকমত বলা হয়। [ফাতহুল কাদীর]

২. #বক্তৃতা হবে সংক্ষিপ্ত:

আবদুল্লাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সপ্তাহের দিনসমূহে আমাদেরকে ওয়াজ-নাসীহাতের ব্যাপারে আমাদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, যাতে আমরা বিরক্ত হয়ে না যাই। (বুখারী:৬৮,মুসলিম:২৮২১)

আমর ইবনুল আস (রাঃ) একদিন বলেন, এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিলো। আমর (রাঃ) বললেন, যদি সে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতো তবে তার জন্য ভালো হতো। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ আমার নিকট উপযুক্ত মনে হয়েছে অথবা আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে ভাষণ সংক্ষিপ্ত করতে। কেননা সংক্ষিপ্ত আলোচনা উত্তম। ( আবু দাউদ:৫০০৮, মিশকাত: ৪৮০৩)

৩. সহজ_সরল_সুসংবাদময়:

হাদীসে ইসলামের দিকে দাওয়াত ও মানুষের মাঝে ফায়সালার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-

عَنْ أَنَسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ يَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوا، وَبَشِّرُوا وَلاَ تُنَفِّرُوا ‏আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সহজ পন্থা অবলম্বন করো, কঠিন পন্থা অবলম্বন করো না, মানুষকে সুসংবাদ দাও, বিরক্তি সৃষ্টি করো না। (বুখারী:৬৯, মুসলিম: ১৭৩৪)

সংকলন ও সম্পাদনায়: সামসুল আলম (#নীল_মুসাফির)

বিষয়: সাহিত্য

৭৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File