তাফসীর: সূরা ২৯ আনকাবুত: ৪৮-৫১ (নিরক্ষরতা নবীর একটি গূণ আর কুরআন হলো শ্রেষ্ঠ মু'জিযা)

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৬:৪৭:০৬ সন্ধ্যা

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে-

وَمَا كُنْتَ تَتْلُو مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلَا تَخُطُّهُ بِيَمِينِكَ ۖ إِذًا لَارْتَابَ الْمُبْطِلُونَ

৪৮: তুমি তো এর পূর্বে কোন গ্রন্থ পাঠ করতে না এবং তা নিজ হাতে লিখতেও না যে, মিথ্যাবাদীরা (তা দেখে) সন্দেহ পোষণ করবে।

তাফসীর: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সূরা আরাফের ১৫৭, ১৫৮ আয়াতে ওম্মী নবী (নিরক্ষর) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এটা তার একটি বিশেষ সিফাত বা গুণ হিসেবেই সকল মুফাসসিরগণ লিখেছেন।

"যারা নিরক্ষর রসূল ও নবীর অনুসরণ করে, যার উল্লেখ তওরাত ও ইঞ্জীল যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়....... (সূরা ৭ আরাফ: ১৫৭)

"সুতরাং আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূল ওম্মী-নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর; যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে বিশ্বাস করে, এবং তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা পথ পাও।’ (সূরা ৭ আরাফ:১৫৮)

এটি তাঁর একটি বিশেষ গুণ। যার অর্থ (তিনি লিখাপড়া জানতেন না, তাঁর অক্ষরজ্ঞান ছিল না) তিনি কোন গুরুর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করেননি। কোন শিক্ষকের নিকট হতে কোন শিক্ষাও তিনি অর্জন করেননি। তা সত্ত্বেও তিনি এমন এক কুরআন পেশ করলেন যে, তার অলৌকিকতা ও সাহিত্য-অলংকারের সামনে পৃথিবীর সকল সাহিত্যিক ও পন্ডিত তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অক্ষম রয়ে গেল। আর তিনি যে শিক্ষা পেশ করলেন, যার সত্যতা ও যথার্থতা পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বীকৃত। আর তা এ কথারই প্রমাণ যে, তিনি সত্যিই আল্লাহর রসূল। তাছাড়া একজন নিরক্ষর, না এ রকম গ্রন্থ পেশ করতে পারে, আর না এমন শিক্ষার বর্ণনা দিতে পারে, যা ন্যায় ও ইনসাফের এক সুন্দর নমুনা এবং বিশ্ব-মানবতার পরিত্রাণ ও সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। এ শিক্ষা গ্রহণ বিনা পৃথিবীর মানুষ সত্যিকার সুখ-শান্তি পেতে পারে না।

নবী সা. নিরক্ষর তথা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন না। এর দ্বারা মূর্খ বুঝায় না। কেননা বর্ণ পরিচয় ছাড়াও মানুষ কথা বলতে পারে, জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমাদের সমাজে অনেক অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও ভালো পন্ডিত। নবীকে আল্লাহই লিখেয়েছেন।

[/b

[b]রাসূলুল্লাহ সা.-এর এটি একটি মুজিযা যে, কুরআনের আগে তিনি কোনো কিতাব পাঠ করেন নি, কোনো কিছু লিখেনও নি; তারপরও এমন কুরআন তিনি (উম্মী)জাতির সামনে পেশ করলেন যা অতুলনীয় ও মানবরচনার ঊর্দ্ধে। তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন তার প্রমাণ সূরা আরাফের ১৫৭-১৫৮ ছাড়াও বুখারী মুসলিমের সহীহ হাদীস-

إنا أمة أمية لا نكتب ولا نحسب

ইবন ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমরা উম্মী জাতি। আমরা লিখি না এবং হিসাবও করিনা। মাস এরুপ অর্থাৎ কখনও উনত্রিশ দিনের আবার কখনও ত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। (বুখারী:সিয়াম অধ্যায়:১৭৯২)

সূরা জুমুআতে বলা হচ্ছে-

তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। (সূরা ৬২ জুমুআ:২)

আল্লাহ তাআলা বলছেন-

"আমি আপনাকে পাঠ করাতে থাকব, ফলে আপনি বিস্মৃত হবেন না" (সূরা ৮৭ আ'লা:৬)

এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহকে আল্লাহ শিখিয়েছেন।

সূরা ১০ ইউনুসের ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে-

قُلْ لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَاكُمْ بِهِ ۖ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِنْ قَبْلِهِ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

১০:১৬: বল, ‘আল্লাহর ইচ্ছা হলে আমি তোমাদের কাছে এটা পাঠ করতাম না এবং আল্লাহ তোমাদেরকে ওটা জানাতেন না। আমি এর পূর্বেও তো জীবনের এক দীর্ঘ সময় তোমাদের মধ্যে অতিবাহিত করেছি; তবুও কি তোমরা বুঝতে পার না?’

আল্লাহ আরো বলেন-

৪২:৫২: এভাবে আমি নিজ নির্দেশে তোমার প্রতি অহী (প্রত্যাদেশ) করেছি রূহ!] তুমি তো জানতে না গ্রন্থ কী, ঈমান (বিশ্বাস) কী? পক্ষান্তরে আমি একে করেছি এমন আলো, যার দ্বারা আমি আমার দাসদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করি। আর নিশ্চয়ই তুমি সরল পথ প্রদর্শন কর-- (সূরা ৪২ শূরা: ৫২)

এই আযাত দ্বারাও প্রমাণ হয় যে, নবী সা. ইতোপূর্বে লেখাপড়া জানতেন না।

সহীহ মুসলিমের (كتاب الجهاد والسير) ৩৪ নং বাবের ৪৪৮০ নম্বর "হুদায়বিয়ার সন্ধি সংক্রান্ত হাদীসে"র ব্যখ্যায় ইমাম নববী আলোচনা করেছেন। যাতে প্রমাণিত হয় নবী সা. উম্মী ছিলেন নিরক্ষর অর্থে।

মিথ্যাবাদী বলতে মক্কার কুরাইশ বা যেকোনো অবিশ্বাসীরা! যদি তিনি শিক্ষিত ব্যক্তি হতেন বা কোন শিক্ষকের নিকট কিছু শিখতেন, তাহলে লোকে বলত যে, কুরআন মাজীদ অমুকের সাহায্যে (রচিত গ্রন্থ) বা অমুকের নিকট শিক্ষার ফল। সুতরাং নবী নিরক্ষর হওয়া তার একটি বিশেষ গুণ যে, তিনি আল্লাহর কালাম বহন করছেন অথচ আগে কিতাব পড়েন নি।

بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ ۚ وَمَا يَجْحَدُ بِآيَاتِنَا إِلَّا الظَّالِمُونَ

৪৯: বরং যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে এ (কুরআন) স্পষ্ট নিদর্শন। কেবল জালিমরাই আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করে।



তাফসীর: এই আয়াতের উদ্দেশ্য রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাহাবী ও তার বিশ্বাসী অনুসারী যারা কুরআনকে পড়ে ও সংরক্ষণ করে। এই কুরআন মাজীদ হাফেযগণের বক্ষে সংরক্ষিত আছে। এই উম্মাতের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। এটা কুরআন মাজীদের এক অলৌকিক শক্তি যে, তা শব্দ সহ বক্ষে সংরক্ষিত হয়ে যায়। এটা মানবরচিত কবিতা বা কোনো যাদু নয়।

وَقَالُوا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آيَاتٌ مِنْ رَبِّهِ ۖ قُلْ إِنَّمَا الْآيَاتُ عِنْدَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُبِينٌ

৫০:ওরা বলে, ‘তার প্রতিপালকের নিকট হতে তার কাছে নিদর্শনাবলী অবতীর্ণ করা হয় না কেন?’ বল, ‘নিদর্শন তো আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণাধীন। আর আমি তো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র।’



তাফসীর: মুশরিকরা নবীর কাছে অন্যান্য নবীর মতো অলৌলিক কিছু প্র্রদর্শনের দাবী করত॥ (আরো দেখুন সূরা ১৭ ইসরা: ৫৯ আয়াতের তাফসীর) আল্লাহ জানাচ্ছেন, সকল নিদর্শন (মুজিযা) কেবল আল্লাহরই হিকমত ও ইচ্ছাধীন। তিনি যার প্রতি অবতীর্ণ করতে চান, তার প্রতি অবতীর্ণ করেন। এতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোন এখতিয়ার নেই।

রাসূলুল্লাহ সা. শুধু একজন সতর্ককারীমাত্র; হেদায়াতের মালিক আল্লাহ। "আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনই তার কোন পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না।"-(সূরা ১৮ কাহফ: ১৭) আরো দেখুন সূরা ২বাকারা: ২৭২

أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَرَحْمَةً وَذِكْرَىٰ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

৫১: এ কি ওদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার নিকট কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা ওদের নিকট পাঠ করা হয়। এতে অবশ্যই বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য করুণা ও উপদেশ রয়েছে।



তাফসীর: মুশরিকদের নিদর্শন দেখার দাবীর জবাবে আল্লাহ আরো জানাচ্ছেন- এই কুরআনই একটা চমৎকার নিদর্শন, যা তিনি একজন উম্মী নবীর উপর নাজিল করেছেন। এই কুরআনের ব্যাপারে তাদের সাথে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এই বলে যে, এইরূপ কুরআন তৈরী করে অথবা একটি সূরা তৈরী করে উপস্থাপন কর, সেই কুরআন তাদের জন্য নিদর্শন হিসাবে যথেষ্ট নয় কি? যখন কুরআনের মু’জিযা দেখার পরেও তারা কুরআনের প্রতি ঈমান আনছে না, তখন মূসা ও ঈসার মত মু’জিযা দেখানো হলেও তার উপর তারা কি ঈমান নিয়ে আসবে?

আল্লাহ আমাদের হক বুঝার তাওফীক দান করুন।

বিষয়: বিবিধ

১০৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File