বিবিসি বাংলার খবর বনাম আমাদের সমাজে পিতামাতার প্রতি ব্যবহার! (ইসলাম কী বলে?)

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:৫৪:২৯ রাত

বিবিসি বাংলার খবর পড়ে ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। বন্ধু জাকিরদের বাড়িতে বেড়াতে গেছি (হয়তো ক্লাস টেনে পড়ি)। মাগরিবের পর জাকির জানালো, একজনের বাড়িতে যেতে হবে এক বৃদ্ধাকে তাওবা পড়ানোর জন্য। ইসলাম সম্পর্কে তখন গভীর জ্ঞান না থাকলেও এইটুকু বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় নি যে, তাওবা করার জিনিস, পড়ানোর জিনিস নয়! জাকির বলল-

ওসব রাখো! ওরা দ্বীনের কোনো ধারণা রাখে না, তাওবা এসতেগফার কী করে করতে হয় জানে না। মাসয়ালা না বলে চলো আমার সাথে......

শীতের রাতে যে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম, তাতে মোটামুটি স্বচ্ছল বলা চলে, খুব বিত্তবান না হলেও। মাটির ঘরগুলো মাঝারি মানের এবং টিনের চালের। আমাদেরকে একটা বড় ঘরের পাশে টিনের চালায় খড়কুটোর বেড়া দেয়া একটা কক্ষে নেয়া (sub Room) হলো। গিয়ে দেখি শীর্ণ, অস্থিসার এক বৃদ্ধা ছেঁড়া কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বসে আছে। বেড়াগুলোর অবস্থা মোটেও ভালো নয়, বাতাস আটকাতে পারছে না। মাটির উপর খড় বিছিয়ে তার উপর নষ্ট তোষকের বিছানা। চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সহবাসী আছে, কয়েকটা ছাগল। ছাগলের তরল পদার্থের গন্ধে এই বৃদ্ধার কী অবস্থা তা না জানলেও আমাদের অবস্থা কাহিল। যদিও অনেক অবস্থাসঙ্কট পরিবারে ছাগলের সাথে মানুষের বাস গ্রামে দূর্লভ নয়।

আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে জাকির বলল, পেশাব-পায়খানার অসুবিধা আর গায়ের গন্ধের জন্য কোনো সন্তানই সাথে রাখতে চায় না। জাকিরের তাওবা (সূরা ফাতিহা, ইখলাস পড়ে, কয়েকবার গদবাঁধা ইস্তেগফার-"আস্তাগফিরুল্লাহি রব্বি মিন কুল্লি জানবিও ওয়া আতূবু ইলাইহি" আর কালেমা শরীফ) পড়ানো শেষ হলে চলে আসি। ইসলামের নামে একটা কুসংস্কার ছিল এই যে, অতি বৃদ্ধদের যারা মৃত্যু পথযাত্রী (মরেও মারা যাচ্ছে না) তাদের তাওবা পড়ানো হলে নাকি দ্রুত আসানের সাথে মারা যায়। এই জন্য অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা অসুস্থ্যরা তাওবা পড়তে চায় না।

পরবর্তীতে আর জানা হলো না, সেই বৃদ্ধা কি দ্রুত মারা গিয়ে পার্থিব নরক থেকে বেঁচে গেলেন আর সন্তানদের উদ্ধার করলেন?

আমাদের সমাজে এই চিত্রটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। চীনের এক মহিলার শূয়োরের খোয়াড়ে বাস নিয়ে হৈ-চৈ আমাদের সমাজের নিদারুন চিত্র মনে করিয়ে দিল। অথচ আমরা মুসলিম বলে দাবি করে থাকি!

ইসলামে মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য সম্পর্ক কী বলে:

কুরআনে আল্লাহ বলছেন-

তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের এক জন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে (বিরক্তিসূচক শব্দ) ‘উঃ’ বলো না এবং তাদেরকে ভৎর্সনা করো না; বরং তাদের সাথে বলো সম্মানসূচক নম্র কথা। (সূরা ১৭ বানি ইসরাইল: ২৩)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পর দ্বিতীয় নম্বরে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও তাঁদের খেদমত করার এবং তাঁদের প্রতি আদব ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার কত যে গুরুত্ব তা পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ, প্রতিপালকের প্রতিপালকত্বের দাবীসমূহের সাথে সাথে পিতা-মাতার দাবীসমূহ পূরণ করাও অত্যাবশ্যক। হাদীসসমূহেও এর গুরুত্ব এবং এর প্রতি চরম তাকীদ করা হয়েছে। বিশেষ করে বার্ধক্যে তাঁদেরকে ‘উঃ’ শব্দটিও বলতে এবং তাঁদেরকে ধমক দিতে নিষেধ করেছেন। কেননা, বার্ধক্যে তাঁরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে যান। পক্ষান্তরে সন্তানরা হয় সবল এবং উপার্জন-সক্ষম ও (সংসারের সব কিছুর) ব্যবস্থাপক। এ ছাড়া যৌবনের উন্মাদনাময় উদ্যম এবং বার্ধক্যের ভুক্তপূর্ব স্নিগ্ধ ও উষ্ণ অভিজ্ঞতার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই সব অবস্থায় পিতা-মাতার প্রতি আদব ও শ্রদ্ধার দাবীসমূহের খেয়াল রাখার মুহূর্তটা হয় অতীব কঠিন। তাই আল্লাহর কাছে সন্তোষভাজন সেই-ই হবে, যে তাঁদের শ্রদ্ধার দাবী পূরণ ও প্রাপ্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হবে।

কুরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে, তোমরা আমার শুকরিয়া আদায় করো এবং পিতা-মাতারও। (সূরা লোকমান : ১৪) এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে আল্লাহ পাকের ইবাদতের পর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা যেমন অতীব জরুরি অনুরূপভাবে পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করাও সন্তানের জন্য জরুরি। (তাফসীরে কুরতুবী: ৫/৫৭৫) এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, কোন এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সময় মতো নামায পড়া। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (সহীহ বুখারী: ১/৭৬)

কুরআনের অন্তত চারটি স্থানে আল্লাহর ইবাদতের আদেশের সাথে সাথেই মাতা-পিতার সাথে সাদাচারের নির্দেশ এসেছে। (২:৮৩; ৪:৩৬; ৬:১৫১; ১৭:২৩) আরো চারটি স্থানে আলাদাভাবে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে বলা হয়েছে- (১৯:১৪; ২৯:৮; ৩১:১৪; ৪৬:১৫) ইসা আ.কে মাতার সাথে সদাচারের সম্পর্কে ১৯:৩২ আয়াত।

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত। (তিরমিযী শরীফ-২/১২) অন্যত্রে হযরত আবু উমামা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তানের ওপর পিতা-মাতার দায়িত্ব কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ, পৃ-২৬০)

------------------------------------------------------------

http://www.bbc.com/bengali/news-38600456

বিষয়: বিবিধ

১০৪৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

381285
১৪ জানুয়ারি ২০১৭ বিকাল ০৪:৪৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ অত্যন্ত শিক্ষনিয় পোষ্টটির জন্য। আমরা এখন তাদের মতই শুধু দুনিয়া নিয়ে ব্যাস্ত।
381296
১৫ জানুয়ারি ২০১৭ দুপুর ০৩:৩০
হতভাগা লিখেছেন : আমাদের মুসলমান সমাজে সন্তান (মূলত ছেলে) কর্তৃক পিতামাতা নিগৃহীত হবার একমাত্র কারণ ছেলের বউয়ের চুকলিবাজি ।

এসব চুকলিবাজি যে ছেলে বোঝে না তা কিন্তু নয় । বরং সামাজিকতা ও নারী নির্যাতনের ভয়ে সে নিরুপায় হয়ে বাধ্য হয় প্রাণপ্রিয় বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যব হার করতে ।

ছেলেদের হয়ে গেছে মহা সমস্যা - বাবা মাকে দেখভাল করলে বউ বেজাড় হয় । বউ কূটনামী করলে বউকে প্রহার করতে গেলে বিনা কৈফিয়তে জেলে যাবার ভয় থাকে । আবার স্ত্রৈন হয়ে চললে বাবা মাকে দেখভাল না করার কারণে নতুন আইনের খপ্পড়ে পড়া লাগবে।

ইসলাম কি শুধু ছেলেদেরকেই বলে বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার না করতে ?

যদি পুত্র বধু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার স্বামীর বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যব হার করে/করায় সে ক্ষেত্রে ইসলাম কি করতে বলে সেই মেয়ের এই কূটনামীর ব্যাপারে?

জামাইরা তাদের শশুর শাশুরি সাথে কুটনামী করে না তাদের বউদের মত।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File