সারা বিশ্বে চলছে রমজানের আমেজ। মুসলমান রয়েছে সিয়াম সাধনাতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে বাংলাদেশের একজন শায়েখ রমজানে মুসল্লিদের ডাকাডাকির বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভোররাতে সাহরির সময় মসজিদের মাইকে অতিরিক্ত ডাকাডাকি এবং গজল গাওয়ার প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত।’ এই মাসয়ালাতে, শায়েখের সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারলাম না। হ্যাঁ, তবে অতিরিক্ত জিনিসই বর্জনীয়। কিন্তু ডাকাডাকি কিংবা রমাজানে তিলাওয়াত, নাশিদের সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে যদি বিরক্তির রোষানলে পড়ে, তাহলে তো ধর্মীয় সংস্কৃতি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে। ধর্মীয় ভারসাম্য ভেঙে পড়বে।
যেমনটি মসজিদে শিশুদের নিয়ে আসা, বিরক্তিবোধে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ধর্মচর্চার ওপর প্রভাব ফেলেছে। ছোটবেলার আদব শিক্ষার অভাবে ইমাম সাহেবকে বর্তমান প্রজন্মে সালাম তো দূরের কথা, খারাপ ব্যবহার করার মতো আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আসুন মূল বিষয়ে যাই। মাইকে আহ্বান করাকে আপাতত একটি ‘সমস্যা’ হিসেবে বিবেচনা করে, চলুন যাই ইসলামী শরিয়াহের উসুলের দিকে। এটি যেহেতু আধুনিক মাসয়ালা সেহেতু এ ব্যাপারে কোনো নস নেই।
উলামায়ে উম্মাহর ঐকমত্যের কাওয়েদুল ফিকহের আওতাধীন শাখা হলো সহজ বাংলায়, বড় একটা জনগোষ্ঠীকে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচাতে গিয়ে, ছোট ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া বৈধ রয়েছে।
আরো সহজভাবে বললে, ধরুন, যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ অবস্থায় মুসলমানদের দিকে এক হাজার কাফের তেড়ে আসছে। এ দিকে মুসলিম যোদ্ধাদের হাতে মিনজানিক (রকেট লঞ্চার) আছে। আঘাত করলেই ধেয়ে আসা সব কাফের মারা পড়বে। কিন্তু সমস্যা হলো, কাফেরদের মধ্যে ৫০ জন মুসলমান সৈনিক যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। যদি মিনজানিক নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে সেই মুসলিম সেনারাও তাদের সাথে মারা পড়বে। এখন কি ৫০ জনকে বাঁচাতে গিয়ে এক হাজার কাফেরকে ছেড়ে দেবেন? যারা ধেয়ে এসে ৫০০ মুসলমানকে শহীদ করবে?
এ ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়াহ আপনাকে বৈধতা দিয়েছে যে, তাদের মধ্যে মুসলমান সৈনিক থাকা সত্ত্বেও আপনি মিনজানিক নিক্ষেপ করতে পারবেন। এটিই হলো মূল কাওয়াদের বক্তব্য। আশা করি আমার বক্তব্য বুঝতে পেরেছেন। এখন আর গুটিকয়েক জনের তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত নিয়ে সমস্যা হবে না। ডাকাডাকির মূল উদ্দেশ্য ও সার্বজনীন ফলাফলের দিকে তাকাতে হবে। আপনি শিক্ষিত মানুষ বলে, অ্যালার্ম কী তা জানেন। কিন্তু গ্রামের ওই কৃষকের কাছে ফোন থাকলেও রিসিভ আর ডায়াল ছাড়া কিছুই জানে না।
মাইকে না ডাকা হলে, হতে পারে অনেক মানুষ ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। রোজাও হয়তো রাখবে না। রোজা ফরজ ইবাদত; কিন্তু আপনার তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত কিন্তু ফরজ ইবাদত নয়। রোজা না রাখতে পারার কারণ হলো, সাহরি খেতে পারেনি। তার তো দিনে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে রক্ত পানি করে উপার্জন করতে হয়। আমি গ্রামের সাধারণ মানুষের উদাহরণ টেনেছি। কারণ আমাদের ১৮ কোটি জনগণের ৭০ শতাংশ মানুষই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। আপনার-আমার মতো এসি রুমে বসে রোজার দিন পার করে না।
এবার আমাকে বলুন, আপনার তাহাজ্জুদে বিঘœ ঘটে, কিংবা তিলাওয়াত অথবা ঘুমে, এ জন্য এতবড় জনগোষ্ঠীর সুবিধার কথা ভাববেন না? মসজিদের মাইকে যা কিছু প্রচার হচ্ছে, এটি তো ইসলামী সংস্কৃতিরই জানান দিচ্ছে। হয়তো আপনার ইবাদতে বিঘœ ঘটে, কিংবা শিশুদের ঘুমাতে কষ্ট হয়, এটি তো সাময়িক ক্ষতি। কিন্তু জেনে রাখুন, এতে একটি জাতির মাইন্ড সেট হচ্ছে। ধর্মের বাণী কানে কানে পৌঁছে যাচ্ছে। মন উৎফুল্ল হচ্ছে। মনে একটা ভালো লাগা কাজ করে। কে জানে, এই আহ্বান শুনে, গুনাহ করতে থাকা কেউ একজন গুনাহ ছেড়ে দিচ্ছে। কিংবা আবেগাপ্লুত হয়ে মসজিদ পানে ছুটছে!
আমাকে বলুন তো রমজান ছাড়া কতজন কুরআন একটু ছুঁয়ে দেখে? নিজ উদ্যোগে ফোন থেকে তিলাওয়াত ডাউনলোড করে শোনে? কিন্তু মাইকে তিলাওয়াত হচ্ছে, ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মানুষ শুনছে। আরে রমজান তো এসেছে কুরআনের জন্য। আর আপনাদের কাছে কিছু অজুহাতে এটি কেন বিরক্তকর মনে হয়, আমার বুঝে আসে না। সাহরিতে ডাকার ব্যাপারে তো কত হাদিস রয়েছে। স্বয়ং রাসূল সা: সাহাবিদের সাহরির জন্য ডেকেছেন। ‘তোমরা বরকতময় সাহরির দিকে আসো।’ (সুনানে আন নাসায়ি)
এ ছাড়াও ইমাম আবু বকর ইবনু আবি শায়বাহ রহ: বর্ণনা করেছেন- ‘আবু রুহম সামাঈ থেকে বর্ণিত- নিশ্চয় তিনি হজরত ইরবাদ ইবনু সারিয়া রা:-কে বলতে শুনেছেন, রাসূলে পাক সা: আমাদেরকে রমজান মাসে সাহরির জন্য ডাকতেন এবং তিনি বলতেন : বরকতময় ভোররাত। (মুছান্নাফে ইবনে আবু শায়বাহ-৮৭২১) হজরত ইরবাদ ইবনু সারিয়া রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: আমাকে রমজান মাসে সাহরির সময় ডেকে বললেন : বরকতময় ভোরের সাহরির দিকে আসো।’ (সুনানে আবু দাউদ-২০০০, মুসনাদে আহমাদ-১৬৮১২, মুজামুল কবির-১৫০৫০)
অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে মাইক ঘুরিয়ে মুসলিম অধ্যুষিতদের দিকে দেয়া। রমজানের সারা রাত ধরে তিলাওয়াত, গজল কেন চলবে? সাহরির আগ মুহূর্তগুলোতে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চলতেই পারে। মিসরে দেখেছি ইফতার ও সাহরির আগ মুহূর্তগুলো তারা এগুলো বাজিয়ে থাকেন। যাতে রমজানের একটি আমেজ-উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। আপনার বাসায় অসুস্থ মানুষ থাকলে জানালা বন্ধ করুন। আমার মনে হয় না যে, গড়ে সব মসজিদের মাইকগুলো এত শক্তিশালী যে, আপনার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। তবে মসজিদের কাছাকাছি বিশেষ কিছু জায়গাতে এমন সমস্যা হতেই পারে। মসজিদে মাইক বাজলে যে ইবাদত করা যায় না, এটি ভুল কথা। মসজিদের মাইকে ঢোল-তবলার গান বাজে না, যা আপনার কর্ণকুহুরে শিহরণ তোলে? না, এমনটি হয় না?
সর্বোপরি, মিসরে দেখেছি, রমজান মাসে প্রতিটি বাসা, প্রতিটি অলিগলি সব কিছু রমজানের নানান শামাদানে সুসজ্জিত করা হয়। চোখ পড়তেই আপনার মনে একটি প্রশান্তি কাজ করবে। সবকিছুই এই মাসের জন্য সজ্জিত হচ্ছে। সব জায়গাতে উৎসবমুখর পরিবেশ।
মসজিদের মাইকগুলোতে সুমধুর তিলাওয়াত ভেসে আসছে। সবাই জায়নামাজ, পাগড়ি, তসবিহ নিয়ে মসজিদে ছুটছে। আতরের ঘ্রাণে সব দিক সুঘ্রাণ। এই পরিবেশে একজন ফাসেকও আল্লাহর অলিতে পরিণত হতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন