বিংশ শতাব্দীতে ভারতে এমন এক মহান মনীষীর আগমন ঘটে, যিনি যুগের স্রোতকে ঘুরিয়ে দেন এবং বাতাসের গতিবেগ রুখে দেন। তিনি এমন এক কাজ শুরু করেন, যে কাজের সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত কোটিরও বেশি মুসলিম। বিশ্বের ১৫০টিরও অধিক দেশের নাগরিকরা নিজে ব্যয়ভার বহন করে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো এবং এক মুসলিমকে প্রকৃত মুসলিম তৈরিতে নিবৃত্ত রয়েছেন। কোটি কোটি মুসলমানের জীবনে এই কাজ বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে এ কাজ ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিত। এই জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
বলা হয়, ভারতের উত্তর প্রদেশ ইসলামের জন্য উর্বর ভূমি। এখানে অনেক প্রসিদ্ধ আলেম, মনীষী ও সমাজসংস্কারক জন্মগ্রহণ করেছেন। এই উত্তর প্রদেশের কান্ধলায় মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) শিশুকালেই কোরআন হেফজ করেন এবং প্রাথমিক শিক্ষা নিজ ঘরে ও গ্রামে অর্জন করেন। এরপর বড়ভাই ইয়াহইয়া কান্ধলবীর সঙ্গে মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.)-এর সান্নিধ্যে থেকে ১০ বছর উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। ১৯০৮ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসানের (রহ.) কাছে বোখারি ও তিরমিজির দরস নেন। এর ২ বছর পর তিনি মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) যখন বাংলাওয়ালী মসজিদে দ্বীনি কাজ শুরু করেন তখন সেখানে মেওয়াতের অধিবাসীরা যাওয়া আশা করত। মেওয়াতের ভক্ত-মুরিদরা তার কাছে মেওয়াত আগমনের আহ্বান করেন। তিনি তাদের কাছে শর্ত দেন, আমি অবশ্যই আসব, তবে তোমরা নিজেদের গ্রামে মক্তব চালু করবে। মাওলানা ইলিয়াস যখন মেওয়াত গমন করেন, সেখানে ১০টি মক্তব প্রতিষ্ঠা করে আসেন। এর কিছুদিনের মধ্যে সেখানে আরও অনেক মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে তিনি দ্বিতীয়বার হজব্রত পালনে মক্কা গমন করেন। ফিরে এসে যখন তিনি মেওয়াতের দ্বীনি কাজের অগ্রগতির খোঁজখবর নিলেন, তখন তিনি হতাশ হলেন। মেওয়াতের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করলেন না।
তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মানুষকে ডেকে দ্বীন শেখানো হবে না, বরং মানুষের কাছে গিয়ে তাদের দ্বীন শেখানো হবে। তাদের ঘর থেকে বের করে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে আসা হবে এবং তাদের ইসলাম ও দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো শিখিয়ে নিষ্ঠাবান (প্র্যাকটিসিং) মুসলিম বানানো হবে। এ সময় মেওয়াতে এক বিশাল ইসলাহি ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তিনি সেখানে বয়ান করে উপস্থিত শ্রোতাদের জামাত নিয়ে আশপাশের গ্রামে বের হওয়ার আহ্বান করেন। এভাবে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু হয় এবং মেওয়াতের অনেক জামাত বিভিন্ন এলাকায় বের হতে থাকে। তিনি প্রতি জুমার নামাজের পর তাদের কাজের কথা শুনতেন, নতুন জামাতের পরিকল্পনা করতেন এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন। এভাবে আলীগড়, দিল্লি, বুলন্দশহর, কান্ধলা, সাহারানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে তাবলিগের জামাত রওনা হওয়া শুরু করে। আলেমরা ও সাধারণের মধ্যে এক দ্বীনি চেতনার আবহ তৈরি হয়।
সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.) তাবলিগের কাজের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে লেখেন, ‘যেখানে কোনো মসজিদ দেখা যেত না সেখানে গ্রামে গ্রামে মসজিদ তৈরি হয়। দেখতে দেখতে উপমহাদেশে হাজার হাজার মসজিদ তৈরি হয়। অসংখ্য মক্তব ও আরবি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। হাফেজের সংখ্যা হাজার থেকে লাখে উন্নীত হয়। আলেমের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমাজে সুদি লেনদেন কমে আসে, হত্যা-রাহাজানি দূর হতে থাকে। অসততা, ঠকবাজি অন্যান্য অসৎ চরিত্র সংশোধন হতে থাকে।’ হজরত ইলিয়াস (রহ.) ১২ জুলাই ১৯৪৪ সালে ইন্তেকাল করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন