গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বজ্রপাতে ১২ জন নিহত হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বজ্রপাতে নিহতের ঘটনা ঘটছে। এভাবে প্রায় দিনই পত্রিকায় বজ্রপাতে হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়। দিনদিন বেড়েই চলছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা। বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ কী, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না আবহাওয়াবিদরা। তাদের মতে, সাধারণত উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বজ্রপাত বেশি হয়। উত্তপ্ত বায়ু যখন দ্রুতগতিতে ঠাণ্ডা হয়, তখন বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়।
এই বজ্রমেঘের ভেতরে বাতাসের দ্রুতগতির আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাতাসের জলীয়বাষ্প একই সময়ে বৃষ্টিকণা, শিশিরবিন্দু ও তুষার কণায় পরিণত হয়। বৃষ্টিকণা ও তুষার কণার পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে তুষারের ইলেকট্রন চার্জ ধাক্কা খায়। ফলে স্থির বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়। এই চার্জ সঞ্চিত হয়ে তীব্র শব্দের বজ্রপাত সৃষ্টি করে। যখন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি করে, তখনই তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়। বাতাসের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত বজ্রবিদ্যুৎ প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উৎপন্ন করে। ফলে বায়ুর দ্রুত প্রসারণ হয় ও তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বাতাসে ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ যতই দ্রুততর হয়, বজ্রপাত তত বেশি মাত্রায় হয়ে থাকে। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনকালে বজ্রের সৃষ্টি হয়, তখন মেঘের ভেতরে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের সম্প্রসারণ ঘটে। এতে প্রচুর ঝলকানি দিয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে বজ্র। তখন এর সামনে মানুষ বা পশুপাখি যা-ই পড়ে, তার নির্ঘাত মৃত্যু হয়। (সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ : ২৯.৪.১৮)
এটা হচ্ছে বজ্রপাতের বাহ্যিক কারণ। তবে পবিত্র কুরআনুল কারিমে বজ্রপাতের মৌলিক কারণ বর্ণনা করা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। কুরআন মাজিদের একটি সূরার নাম ‘রাদ’। যার অর্থই হচ্ছে ‘বজ্র’। কুরআন মাজিদের বিবরণ থেকে জানা যায়, বজ্র হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার একটি শক্তিশালী নিদর্শন। এর মাধ্যমে তিনি পৃথিবীবাসীকে ধমক দেন। সতর্ক করেন। ইরশাদ হয়েছে-‘ বজ্র তাঁরই (আল্লাহর) তাসবিহ ও হামদ জ্ঞাপন করে এবং তাঁর ভয়ে ফেরেশতাগণও (তাসবিহরত আছে)। তিনিই গর্জমান বিজলি পাঠান তারপর যার ওপর ইচ্ছা তাকে বিপদরূপে পতিত করেন। আর তাদের (কাফেরদের) অবস্থা এই যে, তারা আল্লাহ সম্বন্ধেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তাঁর শক্তি অতি প্রচণ্ড।’ (সূরা রাদ : ১৩)
মানুষের কৃতকর্মই বজ্রপাতের মৌলিক কারণ। অত্যাচার, নির্যাতন, সুদ, ঘুষ, জিনা, ব্যভিচার দুর্নীতি, অশ্লীলতা হেন অপরাধ নেই যা আজ সমাজময় ছড়িয়ে পড়ছে না। পাপের সমুদ্রে আকণ্ঠ ডুবে আছি আমরা। আমাদের কৃতকর্মের কারণেই আজ সর্বত্র বিপর্যয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ নিজ হাতে যা কামায়, তার ফলে স্থলে ও জলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ তাদের তাদের কর্তৃক কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করাবেন সে জন্য : হয়তো (এর ফলে) তারা ফিরে আসবে। (সূরা রুম, আয়াত : ৪১)
আমরা যদি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে নিমগ্ন থাকি তাহলে আল্লাহ আমাদের সবাইকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করবেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের প্রবল পরাক্রমশালী প্রভু বলেছেন, যদি আমার বান্দারা আমার বিধান মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতে বৃষ্টি দিতাম, সকালে সূর্য দিতাম এবং কখনো তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ : ৮৭০৮)
বজ্রপাতে করণীয় : আমাদের উচিত সব সময় তাওবাহ ইস্তেগফার করে পাক পবিত্র জীবনযাপন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। পাশাপাশি বজ্রপাত থেকে বাঁচতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর পবিত্র সুন্নাহর অনুসরণ করা। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: যখন বজ্রের আওয়াজ শুনতেন তখন এই দোয়া পড়তেন- ‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বিগাযাবিকা ওয়ালা তুহলিকনা বিআযাবিকা ওয়া আফিনা কাবলা যালিকা’ (হে আল্লাহ! আপনি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাদের মেরে ফেলবেন না। শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিবেন না। এই বজ্রপাতের আগেই আমাদের হেফাজত করুন) (মুসনাদে আহমদ : ৮৭০৮)
হাফেজ ইবনে কাসির রহ: তার তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইবনে আবি জাকারিয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি বজ্রের আওয়াজ শুনে এ দোয়া পড়বে, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’, সে বজ্রের আঘাতপ্রাপ্ত হবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২৯২১৩)
তাই আসুন, আমরা সবাই তওবা ইস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহ অভিমুখী হই। পাক পবিত্র জীবনযাপন করি। সুন্নাহর পবিত্র পরশে বজ্রপাতের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বজ্রপাতসহ সকল প্রকার বিপদাপদ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন