ফজিবর রহমান (৫৮) পেশায় ফেরিওয়ালা। গ্রামে ঘুরে ঘুরে চুড়ি-ফিতাসহ প্রসাধনীসামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। প্রচণ্ড দাবদাহে গত তিন দিন ফেরি করতে বের হননি। আজ শনিবার সকালে দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর এলাকায় আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘এইবারের মতো গরম এই বয়সে আর দেখো নাই। মনে হওছে গা পুড়ি যাওছে। মাঝেমইধ্যে বাতাস পাওয়া যাওছে, কিন্তু সেটা গরম বাতাস। পানি খেয়াও কাজ দেছে নাই। গলা পর্যন্ত শুকি যাওছে। হারা গরিব মানুষ। দোকানদারি না করির পারলে খামো কি? তার উপুরত জিনিসপত্রের যা দাম।’
দিনাজপুরে গত কয়েক দিনে কাঠফাটা অসহনীয় রোদ আর গরম বাতাসে অস্থির হয়ে পড়েছে জনজীবন। রাতে ভ্যাপসা গরম। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যনে সূর্যের চোখ রাঙানি। মধ্য দুপুরে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার অন্তত এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। প্রচণ্ড দাবদাহে বেশি ক্ষতি হয়েছেন লিচুচাষিরা। গরম বাতাসে শুকিয়ে গেছে লিচুর খোসা। গাছ থেকে অপরিপক্ব অবস্থায় লিচু ঝরে পড়ছে।
গত এক সপ্তাহে জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ বেলা তিনটায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৬ ডিক্রি, বাতাসের আর্দ্রতা ২২ শতাংশ। দিনাজপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, গত বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছিল। সাধারণত তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করলেই তীব্র দাবদাহের আওতায় পড়ে। তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ১০ জুন পর্যন্ত জেলায় বৃষ্টির সম্ভাবনা কম।
লিচুচাষিদের ক্ষতি বেশি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী জেলায় ৫ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে ৫ হাজার ৪১৮টি। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩১ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন। শীত কম হওয়ায় গাছে মুকুল কম এসেছিল। তার ওপর অনাবৃষ্টিতে ফলন কমেছে। সর্বশেষ প্রচণ্ড দাবদাহে লিচুচাষিদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
আজ সকালে শহরের কালিতলা নিউমার্কেট এলাকায় লিচুর বাজার ঘুরে দেখা যায় চারুবাবুর মোড় থেকে সুইহারি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় ভ্যান ও ইজিবাইকে করে লিচু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন চাষিরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে আড়তে লিচু নিতে পারছেন না। প্রচণ্ড রোদে লাল রঙের লিচু কালো হয়েছে।
বিরল উপজেলার রবিপুর এলাকার লিচুচাষি শিশির শাহ বলেন, ১২ হাজার মাল (লিচু) আনছি সকাল সাড়ে আটটায়। এখন বাজে ১১টা। এখনো আড়তে নিতে পারিনি। জানালেন, রোদে লিচুর খোসা পুড়ে কালো হয়েছে। দাগওয়ালা লিচুর দামও কমে গেছে। বিরূপ আবহাওয়ায় এবার লিচুচাষিদের খারাপ অবস্থা।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেদানা জাতের প্রতি ১০০টি লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। মৌসুমের শুরুতে যেটা ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এ ছাড়া মাদ্রাজি লিচু প্রতি ১০০টি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা থেকে কমে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, বোম্বাই ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা থেকে কমে ২৫০ টাকা এবং চায়না থ্রি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে কমে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাসিমপুর এলাকার লিচুচাষি ও ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘লিচুর চেহারা দেখে অনেকে দামও বলছেন না। এবার ধরা খাইছি। বাগানে যে লিচু প্রতি এক হাজার কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকায়। সেই লিচু তিন হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারছি না।’
গরমে লিচুর খোসায় দাগ দেখা দিয়েছি, ঝরে পড়ছে গাছ থেকে। আজ শনিবার সকালে দিনাজপুর সদর উপজেলার মাসিমপুর এলাকায়
গরমে লিচুর খোসায় দাগ দেখা দিয়েছি, ঝরে পড়ছে গাছ থেকে। আজ শনিবার সকালে দিনাজপুর সদর উপজেলার মাসিমপুর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো
Advertisement
শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট
প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। শহরের কলেজ মোড় এলাকার মুদিদোকানি সোহেল রানা বলেন, ‘শার্ট খুলে দোকানে বসে আছি। তারপরও শরীর থেকে ঘাম চুয়ে পড়ছে। দোকানে বসে থাকা যায় না।’
ইজিবাইকচালক বাবুল আক্তার বলেন, সকাল আটটায় গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। তিন ঘণ্টায় আয় হয়েছে ৬০ টাকা। রাস্তাঘাটে মানুষই নেই। রাস্তার পিচ পর্যন্ত নরম হয়ে গেছে। এত তাপ যে গাড়িতে বসে থাকা যায় না।
গরমে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন এ এইচ এম বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, গত কয়েক দিনে তাপমাত্রা বেড়েছে। এই তাপমাত্রায় বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পানিশূন্যতা রোধ করতে পানি ও তরল খাবার, ফলমূল প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।
লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি
দিনাজপুর নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড সূত্র জানায়, ডিভিশন-১ বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ মেগাওয়াট। সেখানে সরবরাহ ১১ মেগাওয়াট। ডিভিশন-২-এ চাহিদা ২৯ মেগাওয়াট, সেখানে সরবরাহ ১৪ মেগাওয়াট। হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুতের ঘাটতি। অন্যদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ সূত্র জানায়, তাদের দিনে তাদের বিদ্যুতের চাহিদ ১১০ মেগাওয়াট। সেখানে রাতে তারা পাচ্ছেন ৭০ থেকে ৭৫ ও দিনে ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট।
শহরের মর্ডান মোড় এলাকার রেডিও-টিভির মেরামতকারী রনি আহমেদ বলেন, আজ সকাল ৯টায় বিদ্যুৎ গেছে। আসছে সাড়ে ১০টায়। আবার ১২টায় বিদ্যুৎ গেছে। আসছে সোয়া ১টায়। বিদ্যুতের এ রকম আসা যাওয়ায় কোনো কাজ করতে পারছেন না তিনি।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন চালকল মালিকরা। দিনাজপুর শহরের পাটোয়ারি বিজনেস হাউসের মালিক সহিদুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, ‘বিদ্যুতের ঘাটতিতে চালকল মালিকরা তিন দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। প্রথমত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে যন্ত্রের ওপর চাপ পড়ছে। যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন