রাজধানী ও মহাসড়কের রাস্তাগুলো পিচ ঢালাই দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় বিটুমিন। যে বিটুমিন দিয়ে রাস্তা পাকা হচ্ছে, তা-ই ঘুরেফিরে যাচ্ছে মানুষের পেটে, মিশছে পরিবেশের সঙ্গে। এতে আজকের উন্নয়ন আগামী দিনে হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ।
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নতুন কিছু নয়। কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই শহরের রাস্তায় পানি জমে যায়। আগে ৪০ মিলিলিটারের বেশি বৃষ্টি না হলে পানি জমত না। কিন্তু চলতি বছর জলাবদ্ধতার চিত্র বলে দেয়, ২৫-৩০ মিলিলিটার বৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তা পানিতে ডুবে যায়।
ঢাকার বেশির ভাগ রাস্তা পাকা করতে ব্যবহৃত হয় বিটুমিন। এ ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ৬০-৭০ গ্রেডের গাঢ় বিটুমিন ব্যবহারের কথা বললেও অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত লাভ করতে নিম্নমানের পাতলা বিটুমিন ব্যবহার করে থাকে। এমনিতেই পানিতে বিটুমিন মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে কয়েক ঘণ্টার জলাবদ্ধতায় তরল বিটুমিন পানিতে মিশে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
দেশের মহাসড়কের বেলায়ও একই দশা। প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তার বিটুমিন ধুয়ে পড়ে পাশের ফসলের ক্ষেতসহ আবাদি জমিতে। পানি ও জমির সঙ্গে বিটুমিন মিশে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
বিটুমিনের মতো কেমিক্যাল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম সময় সংবাদকে বলেন, পানি তো আর সবসময় স্থির থাকবে না–এটা গিয়ে একসময় নদীতে পড়ে। যখন নগরের পানি নদীতে যায় তখন এটি তিন ধরনের বর্জ্য নিয়ে যায়। একটি হচ্ছে ফিজিক্যাল বর্জ্য, যেমন: প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ইত্যাদি। পলিথিন ডুবে গিয়ে নদী-খালের তলানিতে জমা হয়, আর বোতল দিনের পর দিন ভাসতে ভাসতে শেষমেশ গিয়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরে।
অন্যদিকে আরেক বর্জ্য হচ্ছে বায়োলজিক্যাল, যেমন: মানুষের মলমূত্র। এগুলো একসময় পানিতে মিশে যায়। তবে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে কেমিক্যাল বর্জ্য। বিটুমিন এদের মধ্যে একটা, যা পানিতে মিশে পানি দূষণ থেকে শুরু করে ভয়ানক স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে। পানিতে কেমিক্যাল পড়লে স্বভাবতই পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, যা পরিবেশগত জায়গা থেকে বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
শহিদুল ইসলাম বলেন, বায়োলজিক্যাল বর্জ্য আপনি শোধনের মাধ্যমে সামাল দিতে পারবেন, ফিজিক্যাল বর্জ্য ছেঁকে পরিষ্কার করতে পারবেন; কিন্তু কেমিক্যাল বর্জ্য আপনি সহজে দূর করতে পারবেন না। পরিবেশে এটির প্রভাব মারাত্মক।
বিটুমিন নিয়ে একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আহসান হাবিব। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, মানুষের ক্যানসার হওয়ার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে বিটুমিন দায়ী। এটা যদি পানিতে মিশে যায়, সেখান থেকে মানুষের পেটে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ছাড়া মহাসড়কের পাশে রাস্তাগুলো থেকে বিটুমিন ধুয়ে আবাদি জমিতে পড়ে। এতে শাকসবজির মতো ফসলে বিটুমিন মিশে যায়। সেখান থেকে মানুষের পেটে যাচ্ছে বিষাক্ত বিটুমিন।
আহসান হাবিব বলেন, বিটুমিন একটা বড় মৌল। কেবল জলাবদ্ধতা নয়, প্রতিদিন রাস্তা দিয়ে যান চলাচলে যে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়, এতে মৌলটি ভাঙতে থাকে। ভেঙে যাওয়া এই হাইড্রোকার্বনের কণাগুলো মিশে যায় পানিতে। সেই পানি পান করে, কিংবা ব্যবহার করে অজান্তেই মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বিটুমিন আদৌ মাটিতে কিংবা পানিতে মেশে কি না, এ নিয়ে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা বলেন একজন কৃষি প্রকল্পের মালিক। তিনি বলেন, ‘মহাসড়কের পাশে আমার একটি কৃষি খামার আছে। খামারের প্রবেশমুখে একটি পুকুর কেটেছিলাম। ভেবেছিলাম, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি জমলে সেখানে মাছ ফেলব। কিন্তু বর্ষাকালে দেখা গেল, পুকুরের পানি কালো কালো হয়ে আছে। বুঝতে বাকি থাকল না, রাস্তার বিটুমিন ধুয়ে পুকুরের পানিতে এসে মিশেছে। এ পানিতে তো আর মাছ চাষ করা যায় না।’
ইনস্টিটিউট ফর সেফটি, কম্পেনসেশন অ্যান্ড রিকভারি রিসার্চের (আইএসসিআরআর) এক গবেষণায় দেখা যায়, কেবল পানিতে মিশলে নয়, বিটুমিন পোড়ালেও আছে মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকি। শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস ও ফুসফুসে ক্যানসারের মতো মারাত্মক সব রোগের কারণ এই বিটুমিনের ধোঁয়া।
কানাডাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্কবিসির এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা বিটুমিনের ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করছেন, তাদের বেশির ভাগই কাশি, মাথাব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, ত্বকের চুলকানি, গলা ও চোখ ব্যথা ও ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত।
বিটুমিনের বিকল্প কী হতে পারে–এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান হাবিব বলেন, ‘আমরা চাইলে কনক্রিটের রাস্তা ব্যবহার করতে পারি। যদিও এটি স্থায়ী সমাধান নয়। তবে যেসব জায়গায় কৃষিজমি ও জলাশয় আছে, তার আশপাশে বিটুমিন দিয়ে রাস্তা পাকা না করাই ভালো।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন