পৃথিবীব্যাপী মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে হৃদরোগে। যার অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ ও তামাকজাত পণ্য সেবন। দেশে বছরে পৌনে তিন লাখ (২ লাখ ৭৭ হাজার) মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যার প্রধান কারণ হিসাবে চিকিৎসকরা এই দুটি বিষয় অর্থাৎ তামাক ও উচ্চ রক্তচাপকে বেশি দায়ী করছেন।
তারা বলছেন, দেশে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ সমস্যা রয়েছে। একইভাবে তামাক সেবন উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ ২৯ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বের মতো দেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট বা হৃদরোগ দিবস-২০২২। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘ইউজ হার্ট ফর এভরি হার্ট’।
এদিকে দিবসটি উপলক্ষ্যে হৃদরোগ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু কর্মসূচি পালিত হবে। আজ সকাল সাতটায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে মিরপুর শেরে-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হবে। সকাল ৯টায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনে একটি গণমুখী সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ, জেনারেল হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগের উদ্যোগে সচেতনতামূলক র্যালি, লিফলেট বিতরণ ও আলোচনা সভার মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, ‘হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। যার দুই-তৃতীয়াংশের বাস বাংলাদেশসহ নিু ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আশঙ্কার বিষয় হলো সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাতে অকাল মৃত্যু বাড়ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশব্যাপী হার্ট অ্যাটাক ও উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি জরুরি হয়ে পড়ছে। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার মানুষ সেবা নিতে আসছেন। তাদের মধ্যে দুইশ থেকে তিনশ জনকে ভর্তি নেওয়া হয়। ১২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে ১২০০ থেকে ১৪০০ জন হৃদরোগী সব সময় ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের দৈনন্দিন এই চিত্রই বলে দেয় দেশে হৃদরোগ পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক।
তিনি আরও বলেন, এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হৃদরোগীদের উপচে পড়া ভিড় বাড়ছে। ফলে ৩১৪ শয্যা থেকে ৪৫০ শয্যা করা হয়। কিন্তু রোগীর তুলনায় এই সংখ্যা একেবারেই কম হওয়ায় ২০২১ সালের মার্চে ১২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। এরপরও সংকুলান দেওয়া চ্যালেঞ্জ হচ্ছে। যেমন আজকেও (বুধবার) ১৩০০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। কিন্তু আগের চেয়ে তিনগুণ রোগী বাড়লেও সাড়ে চারশ বিছানার জনবল ও কিছুসংখ্যক আউটসোর্সিং লোক দিয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে চিকিৎসক-নার্স ও সহায়ক জনবল যতই নিয়োগ দেওয়া হোক তাতে বেশি সুফল মিলবে না। হৃদরোগের কারণ চিহ্নিত করে সেটি প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে হৃদরোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতিবছর বিশ্বে ১৯ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে। যা হৃদরোগ পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে।
গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের যুগান্তরকে বলেন, ‘তামাকজনিত হৃদরোগ ঝুঁকি হ্রাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আইন সংশোধনের পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী। তামাক কোম্পানির অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে খসড়াটি দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে।’
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দেশে অসংক্রামক রোগ বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও সেরিব্রো কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, ক্যানাসার, ডায়াবেটিস ও সিওপিডি বা দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট রোগ বাড়ছে। এর মধ্যে কার্ডিওভাস্কুলার রোগে সবচেয়ে অর্থাৎ ৩০ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছে। দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যায়। এর মধ্যে ২ লাখ ৭৭ হাজার মারা যাচ্ছে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে। এর রোগের ১৯ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে অকালমৃত্যু বা ৭০ বছরের নিচে। যার অন্যতম কারণ হৃদরোগ। আর হৃদরোগের বড় কারণ হচ্ছে তামাকের ব্যবহার, কায়িক পরিশ্রম না করা, অস্বাস্থ্যকর চর্বি, ক্যালরিযুক্ত খাদ্যগ্রহণ ও লবণ বেশি খাওয়া এবং ওজন বেড়ে যাওয়া। এতে উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস হচ্ছে। যাদের এই রোগ হচ্ছে তাদের ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ বেশি হচ্ছে। যারা ধূমপান করছে তাদের এই ঝুঁকি দ্বিগুণ হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের হার্ট ফেউলিউর, হার্ট অ্যাটাক চার থেকে দশগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে, যা অকালমৃত্যুর বড় কারণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে। তামাক উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন