স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যক্রমে নেই কোনো সমন্বয়। অভিযোগ আছে, দেশে করোনা মহামারী এবং ডেঙ্গুর প্রকোপের মতো দুটি দুর্যোগ চলমান থাকলেও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছেন না। তারা সমন্বিতভাবে কাজ না করায় দেশের রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং এ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্তের সঙ্গে প্রকৃত চিত্রের মধ্যে বিরাট ফারাক দেখা যাচ্ছে। সরকারের কাছে সঠিক তথ্য না থাকায় অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশের পরও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনাকাক্সিক্ষত বিলম্ব নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিদপ্তরের একটি শাখার সঙ্গে আরেকটির সমন্বয় না থাকায় করোনার সময় দেড় বছরেও দেশের সব বেসরকারি হাসপাতালে কতজন চিকিৎসা নিয়েছেন তার প্রকৃত হিসাব মানুষ পাচ্ছে না। এমনকি ওই সব হাসপাতালে কতজন রোগী মারা গেল তাও নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। একই অবস্থা ডেঙ্গু রোগী ভর্তি, মৃত্যু, চিকিৎসার তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও।
দেশে ডেঙ্গু রোগ ২০১৯ সালে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সে সময় রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৪১ হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য প্রকাশ করা হতো। কিন্তু তার পর দুই বছর পার হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ খোদ রাজধানীতে কয়েকশ বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা চলছে। এমনকি করোনা টিকা নিয়েও সমন্বয়হীনতা অন্তহীন। প্রাথমিকভাবে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নগর মাতৃসদন ইত্যাদি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের টিকাদানের জন্য নির্ধারণ করা হয়। বাড়ির কাছে হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে প্রচুর মানুষ নিবন্ধন করে। কিন্তু এখন ওইসব প্রতিষ্ঠানে কোনো টিকা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে টিকার অপেক্ষমাণ সাধারণ জনগোষ্ঠীকে নানা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
দেশের সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই শুধু এমনটি ঘটছে তা নয়, প্রবাসীরাও এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শ্রমিকদের করোনা পরীক্ষার জন্য একবার ডিএসসিসি হাসপাতালকে নির্ধারণ করা হলো। পরে আবার আর্মি স্টেডিয়াম ঠিক করা হলো। অন্যদিকে যারা সময়মতো পরীক্ষা করাতে পারেন না, তাদের জন্য হজক্যাম্পে র্যাপিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলো, যা দেশের বেশিরভাগ মানুষের অজানা। অনেকেই শেষ মুহূর্তে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে অধিদপ্তরের বেশিরভাগ পরিচালক অদক্ষ এবং যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। তারা প্রশাসনিক এবং কারিগরি অনেক বিষয়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে অক্ষম। তাদের সরিয়ে দিয়ে যোগ্যতাসম্পন্নদের দায়িত্ব দিতে বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনুরোধ করা হলেও অদৃশ্য কারণে তা হচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন এ প্রসঙ্গে বলেন, অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতা গত ২১ মাস থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যেসব তথ্য দেওয়া হয়, দেশের মানুষ সেই সেবা নিতে গিয়ে বিব্রত হয়েছেন। এক সময় বলা হচ্ছে এসএমএস না পেলে টিকা নেওয়া যাবে না, আবার বলা হচ্ছে এসএমএস লাগবে না। মানুষকে সচেতন করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। করোনা আক্রান্ত বা লক্ষণযুক্ত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পরীক্ষা করাতে পারেনি। এ বছরে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা, সেটি আদৌ সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ডেঙ্গু কার্যক্রম খুব দুর্বলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার তথ্যানুযায়ী, দেশে অনুমোদিত হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকের সংখ্যা ৯ হাজার ৩৪টি। এর মধ্যে নিবন্ধন হালনাগাদ করা আছে ৩ হাজার ১১৭টির। এ ছাড়া ঢাকা শহরে অনুমোদিত হাসপাতালের সংখ্যা ৪৮৮টি, ডায়াগনস্টিকের সংখ্যা ৭৯৬টি। পাশাপাশি ১২৮টি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। অথচ গত শুক্রবার পর্যন্ত সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেছে ঢাকার ২৯টি এবং চট্টগ্রামের ৬টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য দেওয়া। অন্যদিকে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ঢাকার ৪১টি সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে তথ্য দেওয়া হয়। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় সরকারি তথ্যে কী পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সব বেসরকারি হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার নিয়ন্ত্রণে। তারা চাইলেই সব হাসপাতালকে করোনা ও ডেঙ্গুসংক্রান্ত তথ্য প্রদানে বাধ্য করতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য নিয়মানুযায়ী এমআইএস পাঠালে সেখানে আর কোনো ঘাটতি থাকে না। একইভাবে তথ্য প্রদান, তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ইত্যাদি সঠিকভাবে করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এই কাজ অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার করার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের থেকে অব্যয়িত বাজেট ফেরত গেলেও এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রণয়নে এসব তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মনিটরিংয়ের জন্য একটি করে কমিটি করা যেতে পারে। যে কমিটি এসব বিষয়ে নিয়মিত তদারকি করবে এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এসব বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একাধিকবার নির্দেশনা দিলেও সেগুলোর বাস্তবায়নে ধীরগতি লক্ষণীয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম আমাদের সময়কে বলেন, জনস্বাস্থ্যে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। জনবলের ঘাটতি থেকে শুরু করে অনেক কিছু। তবে সেগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ইতোমধ্যে সরকারি হিসাবে করোনায় মৃত্যু ২৬ হাজার অতিক্রম করেছে। আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ লাখের বেশি। কিন্তু এই তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখন পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা গ্রহীতার সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্ল্যানিং ও মনিটরিং) করোনা নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির দায়িত্ব পালন করছেন। তার সভাপতিত্বে একাধিক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক এবং ক্লিনিক থেকে করোনা এবং ডেঙ্গু শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, মৃত্যু এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করার। এ জন্য তিনটি অপারেশন প্ল্যানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক এবং হাসপাতালগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু ২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত কোনো হাল নাগাদ তালিকা অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা এবং এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) দেয়নি। এমনকি তথ্য চেয়ে গত ২৬ আগস্ট এমআইএস থেকে একটি চিঠি পাঠানো হলেও ফল পাওয়া যায়নি। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা করোনা এবং ডেঙ্গু নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য, উপাত্ত এবং প্রাসঙ্গিক কর্মকাণ্ড তাদের এখতিয়ারে থাকলেও বেসরকারি সাকল্যে ১০০টি হাসপাতালের তথ্য ও সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যই তারা উপস্থাপন করে আসছে। এ কারণে রোগের উৎস, বয়স ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করা আজও সম্ভব হয়নি। হয়নি সুস্পষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা। এ বিষয়ে তাদের কর্মকাণ্ড প্রশিক্ষণ এবং বক্তব্যে সীমাবদ্ধ।
এমআইএসের অধীনে কনট্রোলরুম সরকারি তথ্য ডিএসআইএস-২ সফটওয়্যার এবং বিভাগীয় প্রতিনিধিদের কাছ ফোন অথবা ইমেইলে থেকে নিয়ে যাচাই-বাছাই এবং বিশ্লেষণ করে চার্ট আকারে তা প্রকাশ করে। কিন্তু মুষ্টিমেয় লোক দিয়ে কাজ চালানো তাদের জন্য সীমাহীন কষ্ট এবং ক্লান্তিকর ব্যাপার হয়ে উঠেছে। করোনা এবং ডেঙ্গুর রিপোর্ট তৈরির জন্য সপ্তাহের সাত দিনই চব্বিশ ঘণ্টাই তাদের কাজ করতে হয়। এ কারণে তালিকা দীর্ঘায়িত করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহও কম। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক এমআইএস অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান হেলাল বলেন, কী পদ্ধতিতে মাঠ থেকে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, এমআইএস শাখা এবং হাসপাতাল শাখার সব তথ্য একত্রিত করা যায় সেই চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে আমরা একটি সভা করেছি। আশা করছি শিগগিরিই এর সুফল পাওয়া যাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন