স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ও মেডিকেল টেকনিশিয়ান নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির মহা কেলেংকারি হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ইতিপূর্বে এ সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোসহ দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমও এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। খোদ নিয়োগ কমিটিরই দুই সদস্য দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তুলে তথ্য উপাত্তসহ চিঠি লিখেছেন সরাসরি স্বাস্থ্যসচিব বরাবর। টিআইবির বিবৃতিসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবস সময় দেয়া হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দু’মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই নিয়োগ দুর্নীতির মূল কারিগর যারা, নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম এবং সাবেক এপিএস ড. মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সেখকে দুর্নীতির দায় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাদের অপকর্মের দায় থেকে মুক্তি দিয়ে তদন্ত রিপোর্ট কোনোভাবেই তৈরি করা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই রিপোর্ট পেশ করতে বিলম্ব হচ্ছে।
সূত্রমতে, তদন্ত কমিটিকে কার্যপরিধি এমনভাবে বেঁধে দেয়া হয়েছে, যাতে এপিএস আরিফ বেঁচে যান। কিন্তু নিয়োগ কমিটির সদস্যদের অভিযোগ এবং মূল ঘটনা খতিয়ে দেখতে গেলে এপিএস আরিফকে কোনোভাবেই বাঁচানো সম্ভব নয়। কারণ, খোদ নিয়োগ কমিটির সদস্যই লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন, এপিএস আরিফ তাকে কোটি টাকা ঘুষ এবং পদোন্নতির প্রলোভন দিয়েছেন। নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিবের এমন অভিযোগকে আমলে না নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা আদৌ সম্ভব নয়। এছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে সেই প্রমাণ রয়ে গেছে লিখিত পরীক্ষার খাতায়ই। লিখিত পরীক্ষার খাতা পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তন কারা, কীভাবে করেছে- এর জবাব নিয়োগ কমিটির সভাপতিকেই দিতে হবে। তাই তাকেও কোনো ক্রমেই বাঁচানো যাচ্ছে না। যদিও তিনি গণমাধ্যমে নানা কথা বলে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন, বাস্তবে এসব অপকর্মের দায় থেকে তাকে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই, সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এমন মত ব্যক্ত করছেন।
শুরুতেই দুর্নীতি-কেলেংকারি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ও মেডিকেল টেকনিশিয়ান পদে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। যে কারণে অনেক পদও খালি রয়েছে। তবে গত বছর হঠাৎ করে করোনা মহামারি দেখা দেয়ায় এসব পদে লোক নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়ে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ও মেডিকেল টেকনিশিয়ানের নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। জরুরিভিত্তিতে মেডিকেল টেকনোলোজিস্টের ৮৮৯টি পদে এবং মেডিকেল টেকনিশিয়ান ১৮০০টি পদে লোক নিয়োগের প্রক্রিয়াও শুরু হয়। আর একে কেন্দ্র করেই শুরু হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরকেন্দ্রীক দুর্নীতিবাজচক্রের অপতৎপরতা। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হবার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ঘুষ লেনদেন। মেডিকেল টেকনোলোজিস্টের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ইং। মেডিকেল টেকনিশিয়ানের লিখিত পরীক্ষা হয় ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর। পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগে ১২ ডিসেম্বর থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সামনে লাগাতার বিক্ষোভ হতে থাকে। চাকরি প্রার্থীদের সংগঠন, ‘২০২০ নিয়োগ বাস্তবায়ন কমিটি’র ব্যানারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি বরাবর লেখা এক চিঠিতে মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট নিয়োগ পরীক্ষা স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম এ ব্যাপারে পদক্ষেপও নেন। কিন্তু নিয়োগ কমিটির সভাপতি, পরিচালক (প্রশাসন) শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমামসহ নেপথ্যের গডফাদারদের অপকর্মের কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। ফলস্বরূপ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই নিয়োগ দুর্নীতি এখন মহা কেলেংকারিতে রূপ নিয়েছে।
সিন্ডিকেটে যারা আছেন
মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ৮৮৯ জন ও মেডিকেল টেকনিশিয়ান ১৮০০ জন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি হয় ২৯ জুন, ২০২০। তখন থেকেই এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন অধিদফতরের তখনকার উপপরিচালক (প্রশাসন) আফম আখতার হোসেন। যিনি চাকরিজীবনে বরাবরই একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত। ইতিপূর্বে মহাখালীস্থ বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত থাকাকালে কর্মচারী নিয়োগ কেলেংকারিতে জড়িত থাকার দায়ে পদাবনতি দিয়ে বদলি করা হয়েছিল তাকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় ডিপিএম হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় পুনরায় বদলি করা হয় তাকে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তদবির চালিয়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসন শাখায় সহকারী পরিচালক পদে পদায়ন নেন। এই পদে আসার পর নিজস্ব একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন আখতার হোসেন। তিনি এখানে এসেই শুরু করেন বদলি-পদায়ন বাণিজ্য। এই সিন্ডিকেটে তার সহযোগী হিসেবে কর্মচারীদের মধ্যে ছিলো জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট মো. আশিকুর রহমান, একই প্রতিষ্ঠানের মো. আওলাদ হোসেন খান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক মো. মহব্বত হোসেন খান, পরিচালক এমবিডিসি এর দফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল মমিন শেখসহ কয়েকজন। বদলি, পদায়ন, পদোন্নতিসহ প্রশাসন শাখার নানা কর্মকাণ্ডে এরা তদবির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর পর এই চক্রটির সামনে বড় একটা সুযোগ এসে যায়। আর এটিকে কেন্দ্র করেই এরা ব্যাপকহারে ঘুষ বাণিজ্যে নেমে পড়েন। ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) পদে ছিলেন ডা. বেলাল হোসেন। অনেকটা তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই এই সিন্ডিকেটের কর্মকাণ্ড চলছিলো। সরকারের সিদ্ধান্তে নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই যে ১৪৫ জনকে বিশেষ ব্যবস্থায় মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয় তাতে ব্যাপক ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে মহা কেলেংকারিও বেধে যায়। দুর্নীতির দায়ে ডা. বেলাল হোসেনকে পরিচালক (প্রশাসন) পদ থেকে বদলি করা হয়। পরিচালক (প্রশাসন) পদে আসেন ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম। সেই থেকে তিনি পদাধিকারবলে নিয়োগ কমিটিরও সদস্যসচিব। ডা. হাসান ইমামকে ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক পদ থেকে এখানে পদায়ন করা হয়। তিনি ইতিপূর্বে স্বাস্থ্য অধিদফতরে সহকারী পরিচালক ও উপপরিচালক পদে এক সময় কাজ করেছিলেন। সেই সময় বড় কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেনি। তাই মনে করা হয়েছিল, মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ও টেকনিশিয়ানের এই বড় আকারে নতুন নিয়োগ তার হাত দিয়ে স্বচ্ছভাবেই পরিচালিত হবে। কিন্তু, এখানে যোগ দেয়ার পর দেখা গেলো সেই হাসান ইমাম আর নেই। ঢাকা বিভাগের পরিচালক পদে কাজ করতে গিয়ে ইতিমধ্যে দুর্নীতিতে তার হাত অনেক পেকে গেছে। ঢাকা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়টি অনেক আগে থেকেই দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত। সেখানে কাজ করতে গিয়ে ডা. হাসান ইমাম নিজেকে একেবারেই পাল্টে ফেলেছেন, একথা বুঝা গেলো তিনি এখানে যোগদানের কয়েকদিনের মাথায়ই। কারণ, তিনি এখানে এসেই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিশে যান। এরপর নিজের মতো করে সাজাতে থাকেন নতুন সিন্ডিকেট। অধিদফতরের বাইরে থেকেও চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের অধিদফতরে এনে জড়ো করতে থাকেন। এসময় স্বাস্থ্যখাতের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ফারুক হাসানকে এনে অধিদফতরের প্রশাসন শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদায়ন করেন। তার আগে নিজের পিএ পদে বসান আরেক দুর্নীতিবাজ কর্মচারী আহসান সাইয়েদ এরশাদকে। এসব পদায়নে তিনি ডিজির মতামতকেও পাত্তা দিচ্ছিলেন না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন সারাদেশের ৩য় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বদলি-পদায়ন, পদোন্নতিসহ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) এর নেতৃত্বে যে কমিটি রয়েছে সেটির বৈঠকও তিনি হতে দেননি দীর্ঘদিন ধরে। নিজের মতো করেই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলে পরবর্তীতে অতিরিক্ত মহাপরিচালককে বাদ দিয়ে পরিচালক (প্রশাসন) নিজের নেতৃত্বে বদলি-পদোন্নতি কমিটি গঠন করেন এবং সেই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মচারি বলে চিহ্নিত ফারুক হাসানকে।
নাটের গুরু এপিএস আরিফ
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডা. হাসান ইমাম অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) পদায়নের শুরুতে উপপরিচালক (প্রশাসন) আফম আখতার হোসেনের সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে কাজ করলেও ক্রমান্বয়ে ঘুষ লেনদেনের পুরো সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন। তাকে এসব অপকর্মে নেপথ্যে থেকে সহযোগিতা করছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাবেক এপিএস ড. মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সেখ। বদলি-পদায়নসহ পরিচালক (প্রশাসন) এর নানা অপকর্মে এপিএস আরিফ মূলতঃ নাটের গুরু হিসেবে কাজ করছিলেন। বিশেষ করে টেকনোলোজিস্ট নিয়োগ দুর্নীতিতে নেপথ্য থেকে আরিফুর রহমান সেখই গডফাদার হিসেবে কাজ করছিলেন। উল্লেখ্য, দুর্নীতির দায়ে ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এপিএস পদ থেকে ড. আরিফকে বহিষ্কৃত করতে বাধ্য হলেও এখন পর্যন্ত আরিফই অঘোষিত এপিএস হিসেবে সক্রিয় আছেন। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য হিসেবেই মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে যৌথভাবে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি-লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এছাড়াও এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক এমবিডিসি ও লাইন ডাইরেক্টর টিবি-লেপ্রোসি ডা. সামিউল ইসলাম সাদী। ডা. সাদীর উত্থান ঘটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সময়। ওই সময় পরিচালক (হাসপাতাল) পদে থাকাকালে ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট, কেলেংকারির জন্ম দেন তিনি। গত বছর ১৪৫ জন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট সরাসরি নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের যে কেলেংকারি হয় তাতে ডা সাদীর একারই ছিলো ৬০ জন, একথা সাদী নিজেই গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন। ওই নিয়োগে তিনি তার দফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল মমিন শেখ এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেন বলে জানা যায়। প্রতিটি নিয়োগে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়। অবশ্য এই অর্থের একটি অংশ তখনকার নিয়োগ কমিটির সদস্যদেরও দেয়া হয়।
ভাগ-বাটোয়ারার দ্বন্দ্বে আখতার আউট, আরিফ-হাসান ইমাম নতুন জোট
যেহেতু সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৪৫ জনকে নিয়োগ দিতে গিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে তাই প্রধানমন্ত্রীর দফতর চাচ্ছিলো এই বড় নিয়োগটা যাতে স্বচ্ছভাবে হয়। কিন্তু দেখা গেলো, ডা. বেলাল হোসেনকে দুর্নীতির দায়ে বদলি করা হলেও আখতার হোসেনসহ সিন্ডিকেটের অন্যরা আগের মতোই পুরোমাত্রায় ঘুষ লেনদেন চালিয়েছেন। মূলতঃ এই নিয়োগ দুর্নীতিতে নেপথ্য থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এপিএস আরিফ। আর এ কারণেই ডা. বেলালকে বদলি করা হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং হাসান ইমাম আসার পরে সিন্ডিকেট আরো প্রসারিত হয়। সিন্ডিকেটে নিজের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তিনি একে একে বাইরে থেকে শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের ডিজি অফিসে পদায়ন করতে থাকেন, যাদের সঙ্গে ইতিপূর্বে ঢাকা বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয়ে নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন। কারা নিয়োগ পাবেন, লিখিত পরীক্ষার আগেই এরকমের একটি গোপন তালিকাও এপিএস আরিফ, হাসান ইমাম, আখতার হোসেন সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলেছিলেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক হাসানের তখন পর্যন্ত যদিও ডিজি অফিসে পদায়ন হয়নি, কিন্তু তিনি নিয়মিতই ডিজি অফিসে আসছিলেন। পরিচালক (প্রশাসন) এর কক্ষে বসে আনঅফিসিয়ালি অফিস করছিলেন। সবকিছু তাদের পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছিলো। লিখিত পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সেটিকে পাত্তা দিচ্ছিলেন না এই সিন্ডিকেট। পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষা শুরু হলে পূর্বের তালিকা অনুযায়ী চাকরি চূড়ান্ত করার মুহূর্তে টাকার লেনদেন নিয়ে গণ্ডগোল বেধে যায় হাসান ইমাম, এপিএস আরিফ আর আক্তার হোসেনের মধ্যে। প্রতিটি নিয়োগ প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ৮৮৯ এবং ১৮০০ মেডিকেল টেকনিশিয়ান নিয়োগের এই প্রক্রিয়ায় দেড়শ’ থেকে দু’শ কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনের কারবার চলছিলো। যার অধিকাংশই লিখিত পরীক্ষার আগে অগ্রিম লেনদেন হয়ে গেছে এই টাকা অন্যদের হাত ঘুরে এপিএস আরিফের গোপন একাউন্টে জমা হচ্ছিলো।
মৌখিক পরীক্ষায় নিয়োগ প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করার সময় এই বিশাল অংকের টাকার লেনদেনে এপিএস আরিফ, নিয়োগ কমিটির সভাপতি, পরিচালক হাসান ইমাম এবং সদস্যসচিব, উপপরিচালক আখতার হোসেনের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব বেধে যায়। দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে এপিএস আরিফ মন্ত্রীকে দিয়ে উপপরিচালক আখতার হোসেনকে অধিদফতরের বাইরে বদলির ব্যবস্থা করেন। এর মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরো নিয়ন্ত্রণ পরিচালক হাসান ইমাম আর এপিএস আরিফের হাতে চলে আসে। স্বাস্থ্যখাতের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, পরিচালক (এমবিডিসি), লাইন ডাইরেক্টর টিবি-লেপ্রোসি ডা. সাদীও এদের সঙ্গে ছিলেন। এরা টাকা কালেকশনের সুবিধার্থে কর্মচারীদের একটা নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। দুদক কর্তৃক চিহ্নিত শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মচারীÑ প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ফারুক হাসান, পরিচালক (প্রশাসন) এর পিএ আহসান সাইয়েদ এরশাদ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত প্রশাসনিক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, ডিজি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল, পরিচালক (এমবিডিসি) এর দফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মমিন শেখ- এই চক্রটি ডিজি অফিসে বসে অতিদ্রুত সারাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে। এখান থেকে সর্বত্র চাকরিপ্রার্থীদের কাছে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয়া হয় যে, সাবেক উপপরিচালক আ ফ ম আখতার হোসেনের তৈরিকৃত তালিকা বাতিল। নতুন করে গোপন তালিকায় নাম লেখাতে হবে। এই তালিকায় নাম উঠাতে না পারলে চাকরি হবে না। লিখিত পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, কুর্মিটোলা হাসপাতালের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের অন্যতম পরিচয় হলো, তিনি স্বাস্থ্যখাতের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মিঠু সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। কুর্মিটোলা হাসপাতালে মিঠুর শত শত কোটি টাকা লুটপাটের অন্যতম সহযোগী এই দেলোয়ার হোসেন। হাসপাতালটির বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমদের পদায়ন হবার পর তার হাতে এসব অপকর্ম ধরা পড়লে তিনি দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। তবে ঠিকাদার মিঠুর তদবিরের চাপে পরবর্তীতে বড় কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে দেলোয়ারকে এখান থেকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় রাজবাড়িতে। কিন্তু তিনি রাজবাড়িতে অফিস না করে ডিজি অফিসে ফারুক হাসানের সঙ্গে প্রশাসন শাখায় বসে নিয়মিত ঘুষ লেনদেনের অপকর্মে নিয়োজিত আছেন।
লিখিত পরীক্ষার খাতা পরিবর্তনসহ নানা জাল-জালিয়াতি
এপিএস আরিফ পরিচালক হাসান ইমাম ও উপপরিচালক আক্তার হোসেনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র গোপনে বিতরণ করা হচ্ছিলো। জাতীয় স্বাস্থ্য গ্রন্থাগার ভবনে অগ্রিম প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হচ্ছে, গোপন মাধ্যমে এমন খবর জানতে পারেন মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি জরুরিভিত্তিতে পরীক্ষার আগের রাতেই বিশেষ ব্যবস্থায় নতুন প্রশ্নপত্র তৈরির নির্দেশ দেন। এতে মহা বেকায়দায় পড়ে যান আখতার, হাসান ইমাম, এপিএস আরিফ সিন্ডিকেট। তারা তাৎক্ষণিকভাবে নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। ইন্টারনেটের বিশেষ লিংকের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে উত্তরপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করেন পরীক্ষার হলে। যদিও মোবাইল ফোন এবং এ ধরনের কোনো ডিভাইস নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো, তবে বাস্তবে দেখা গেছে বিশেষ কয়েকটি কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। ওইসব কেন্দ্রে তাদের তালিকাভুক্ত পরীক্ষার্থীরা বেশি ছিলো। তাৎক্ষণিকই এ ধরনের প্রকাশ্য জাল-জালিয়াতির ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন চাকরিপ্রার্থীরা। নিয়োগ পরীক্ষার পরে ওইদিন দুপুর থেকে বিকেল নাগাদ ডিজি অফিসে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং মানববন্ধনও হয়েছে এর প্রতিবাদে। কিন্তু কাজ হয়নি।
তবে নির্ধারিত চাকরিপ্রার্থীদের মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে এবং উত্তরপত্রের লিংক পাঠিয়েও পুরোপুরি সফল হতে পারেননি সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরীক্ষার আগের রাতে ডিজি কর্তৃক হঠাৎ প্রশ্নপ্রত্র পরিবর্তন করাটা এবং প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়াটা সিন্ডিকেটের জন্য বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। বলা যায়, অনেকটা তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। তাদের তালিকাভুক্ত অনেক প্রার্থীই পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি। তাই পরীক্ষার পরে লিখিত পরীক্ষার খাতা পরিবর্তনের মতো মহা জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেয় এই সিন্ডিকেট। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষকদের সঙ্গে এ বিষয়ে গোপন সমঝোতা হয় আরিফ, হাসান ইমাম, ডা. সাদী, আখতার সিন্ডিকেটের। তালিকাভুক্ত নিয়োগপ্রার্থীদের দিয়ে নতুন খাতায় উত্তর লিখিয়ে রাতের বেলায় ডিজি অফিসে এগুলো আনা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পরীক্ষকদের ইতিপূর্বে প্রদান করা খাতার সঙ্গে এগুলো পরিবর্তন করা হয়। আর এ কারণেই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্নপত্রেও অনেক চাকরিপ্রার্থী গণহারে অস্বাভাবিক নম্বর, এমনকি প্রায় ফুল মার্কসও পেয়েছে, বাস্তবে যেটা একেবারেই কল্পনাতীত বিষয়। তাছাড়া এই খাতাগুলোয় উত্তরপত্র যে পরীক্ষার হলে লেখা হয়নি, অন্যত্র ধীরেসুস্থে লেখা হয়েছে এটা হাতের লেখা দেখলেই বোঝা যায। একেবারে মুক্তার হরফের মতো লেখা উত্তরপত্র! নিয়োগ কমিটির যে দু’জন সদস্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তারা এ বিষয়টিকেও গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন।
দুই সদস্য বেঁকে যাওয়াই কাল হলো
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই এগোচ্ছিল। কিন্তু প্রথম সমস্যা দেখা দিলো আফম আখতার হোসেনের সঙ্গে টাকার ভাগাভাগি নিয়ে গণ্ডগোল বেধে যাওয়ায়। এরপর সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিলো নিয়োগ কমিটির দুই সদস্য ঘুষ লেনদেন ও নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে বেঁকে বসায়। আরিফ-হাসান ইমাম সিন্ডিকেটের একেবারে ধারণার বাইরে ছিলো এমনটা। তারা মনে করেছিলেন, টাকার লোভ কে-না গ্রহণ করবে? তাছাড়া মন্ত্রণালয়সহ উর্ধ্বতন প্রশাসনও তাদের হাতের মুঠোয়। কাজেই তাদের ইচ্ছের বাইরে কেউ টু শব্দটিও করতে পারবে না। কিন্তু আফম আখতার হোসেনের পরিবর্তে উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে যাকে আনা হলো, সেই ডা. মো আবুল হাশেম শেখ নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে এতোটা বেঁকে বসবেন তা ছিলো আরিফ-হাসান ইমাম সিন্ডিকেটের একেবারে কল্পনারও বাইরে! এর আগে নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানকে ম্যানেজ করা যাচ্ছিলো না। তিনি এসব দুর্নীতির ব্যাপারে বেঁকে বসেছেন আগে থেকেই। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। পরীক্ষার খাতায় অনেক পরীক্ষার্থীর অস্বাভাবিক নম্বর পাওয়া এবং খাতার হাতের লেখা অস্বাভাবিক রকমের পরিষ্কার হরফের হওয়াসহ প্রভৃতি অসঙ্গতি তার চোখে ধরা পড়ে। বেশ কঠিনভাবেই প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়েছে। সেই কঠিন প্রশ্নেপত্রেই অনেক চাকরিপ্রার্থী প্রায় পুরো নম্বর পেয়েছেন, যা একেবারেই অসম্ভব! তিনি লিখিত পরীক্ষার খাতাগুলো মিলিয়ে দেখতে গিয়ে অবাক হলেন। অনেক খাতায় এতো সুন্দর হাতের লেখা, মুক্তোর মতো ম্পষ্ট অক্ষরে এবং এতো সঠিকভাবে উত্তরপত্র লেখা হয়েছে যে, কোথাও কলম ধরার সুযোগ নেই। খাতাগুলো পরীক্ষার হলে নয়, অন্য কোথাও ধীরস্থিরভাবে লেখা হয়েছে বলেই তার মনে হলো। এরপর মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে দেখা গেলো, যেসব চাকরিপ্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অস্বাভাবিক ভালো নম্বর পেয়েছেন তাদেরকে একই প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেয়ার পর কিছুই লিখতে পারেননি। এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে তিনি সরাসরি তখনকার স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছিলো না।
উপসচিব শারমিন আক্তারের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত বা অন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপই নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে এরমধ্যে হঠাৎ করেই উপপরিচালক (প্রশাসন) আ ফ ম আখতার হোসেনকে অধিদফতর থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তাকে বদলি করা হয় মূলতঃ ঘুষ লেনদেনের ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করেই। আখতার হোসেনের জায়গায় নিয়োগ পান ডা. মো. আবুল হাশেম শেখ। তিনি এর আগে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। পদাধিকারবলে তিনি এই নিয়োগসংক্রান্ত কমিটির সদস্যসচিব হন। তিনি যখন এ পদে এসেছেন তখন মৌখিক পরীক্ষা চলছিলো। উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানের মতো আবুল হাশেমও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং এর বিপরীতে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর দেখে অবাক হন। তিনি সবেমাত্র এই পদে যোগদান করেছেন। তবে শারমিন আক্তার জাহানের মাধ্যমে এই নিয়োগ দুর্নীতির পুরো ঘটনা জেনে যান। ডা. হাশেম এবং উপসচিব শারমিন আক্তার উভয়েই সিদ্ধান্ত নেন সঠিকভাবে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করবেন। মৌখিক পরীক্ষায় যারা পাস করবে না তাদেরকে ফেল ধরা হবে অর্থাৎ তারা চাকরি পাবে না। এমন পরিস্থিতিতে মহা বিপাকে পড়ে যায় হাসান ইমাম-এপিএস আরিফ সিন্ডিকেট। সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। এমন অবস্থায় এপিএস আরিফ তার ঘনিষ্ঠ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) শ্রীনিবাস দেবনাথকে এ কাজে ব্যবহার করেন। শ্রীনিবাস দেবনাথ উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. হাশেমের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কোটি টাকা ঘুষ এবং পরিচালক (প্রশাসন) পদে পদোন্নতির অফার দেন। এপিএস আরিফকে ফোনে সংযোগ ঘটিয়ে দেন। আরিফ নিজের মুখে ডা. হাশেমকে এ অফারগুলো দেন। কিন্তু ডা. আবুল হাশেম সচিব বরাবর চিঠি লিখে এসব কাহিনী ফাঁস করে দেন।
‘শুক্রবারে এক কোটি টাকা দেব’
অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে নতুন নিয়োগ পাওয়া ডা. আবুল হাশেম শেখ গত ৮ মার্চ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে একটি চিঠি দিয়ে তাঁকে ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তোলেন। তখন স্বাস্থ্যসচিবের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল মান্নান। চিঠিতে ডা. আবুল হাশেম লিখেছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) শ্রীনিবাস দেবনাথ গত ১ মার্চ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তখনই তিনি ঘুষের প্রস্তাব দেন।
ডা. হাশেম আরও লেখেন, ‘তিনি (শ্রীনিবাস) বললেন শুক্রবারে আপনাকে এক কোটি টাকা দেব, কোথায় দেখা করব? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী জন্য আমাকে এত টাকা দেবেন? তিনি জানালেন, আমরা যে তালিকা দেব, তাঁদেরকে ভাইভা বোর্ডে পাস করিয়ে দিতে হবে। তাঁরা লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেছেন।’
সেদিনের সাক্ষাৎকালে উপসচিব শ্রীনিবাস উপপরিচালক ডা. হাশেমকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) পদে পদোন্নতির লোভ দেখান বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। এতে ডা. হাশেম আরও লেখেন, কথা বলার সময় শ্রীনিবাসের মুঠোফোনে একটি ফোন আসে। শ্রীনিবাস ফোনটি তাঁকে দিয়ে বলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এপিএস কথা বলবেন। তখন আরিফুর নামে একজন বলেন (ডা. হাশেমকে), তিনি যেভাবে বলেছেন সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
চিঠিতে ডা. আবুল হাশেম স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে বলেন, ‘আমি শ্রীনিবাস দেবনাথকে জানালাম, ঘুষের বিনিময়ে কোনো কাজ করতে অপারগ। তিনি জানালেন, এক কোটি টাকা শেষ নয়, নিয়োগের পরে আরও পাবেন, চিন্তা করে দেখুন।’
ডা. হাশেমের চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, শ্রীনিবাস দেবনাথ অনেকের সঙ্গে জড়িত হয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য পরিচালনা করেন। চিঠিতে ডা. হাশেম নিয়োগ-বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার অনুরোধ জানান স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে।
উল্লেখ্য, শ্রীনিবাস এবং আরিফুর দুজনেই ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। আরিফুর রহমান সেখ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস পদে ছিলেন। নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আরিফুর রহমান সেখ বর্তমানে পরিকল্পনা বিভাগে সিনিয়র সহকারী প্রধান পদে কর্মরত আছেন। কিন্তু বাস্তবে আরিফুর রহমানই এখনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস হিসেবে পরিচিত স্বাস্থ্যখাতে। দীর্ঘদিন জাহিদ মালেকের পিএস-এপিএস পদে কাজ করার সুবাদে ওই পরিবারের সঙ্গে এক ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আরিফুর রহমানের। মন্ত্রীর বাসায় এখনো নিয়মিত তার যাতায়াত রয়েছে। মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে যৌথভাবে গোটা স্বাস্থ্যখাত দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন এই আরিফুর।
নিয়োগ কমিটির আরেক সদস্য, উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানের অভিযোগে যা আছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টেকনোলজিস্ট ও টেকনিশিয়ান নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার অনিয়মের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব ও নিয়োগ কমিটির সদস্য শারমিন আক্তার জাহান স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে চিঠি দেন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। তিনি উল্লেখ করেন, নিয়োগ কমিটির সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দীপঙ্কর বিশ্বাসের প্রস্তাব ও কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগকে লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শারমিন আক্তার জাহান লিখেন, লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অত্যন্ত কঠিন ছিল। কঠিন প্রশ্নেও উত্তীর্ণদের বেশির ভাগ অনেক ভালো নম্বর পান। কিছু খাতা খুলে দেখা যায়, মুক্তার মতো হরফে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লেখা, যেখানে কলম ধরার কোনো সুযোগ নেই। এত নম্বর পাওয়া খুবই অপ্রাসঙ্গিক ছিল। চিঠিতে শারমিন আক্তার আরও উল্লেখ করেন, মৌখিক পরীক্ষা শুরু হলে দেখা যায়, যাঁরা অনেক নম্বর পেয়েছেন, তাঁরা মৌখিক পরীক্ষার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। যাঁরা ৪০ থেকে ৫৯ পর্যন্ত নম্বর পেয়েছেন, তাঁরা অনেক ভালো মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছেন, পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।
শারমিন আক্তার চিঠিতে বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। এ বিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’ এসব অভিযোগ স্বাস্থ্যসচিবকে জানানো হলে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানান। এরপর দীপঙ্কর বিশ্বাসকে নিয়োগ কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর কোনোই ব্যবস্থা নেয়নি স্থাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
দু’মাসেও শেষ হয়নি পাঁচ কর্মদিবস্ত
নিয়োগ কমিটির সদস্য, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহানের স্বাস্থ্যসচিব বরাবর লেখা অভিযোগটি ছিলো যদিও অত্যন্ত গুরুতর, কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। শারমিন আক্তার জাহান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা চাই যাঁদের নামে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের সবার বিষয়ে তদন্ত করা হোক।’ শারমিন আক্তারের চিঠিতে এটা পরিষ্কার যে, লিখিত পরীক্ষার খাতা পরিবর্তন হয়েছে, জাল-জালিয়াতি হয়েছে। পরীক্ষার হলের বাইরেই কোনো স্থানে ওই সুনির্দিষ্ট খাতাগুলো ধীরস্থিরভাবে লেখা হয়েছে। তা নাহলে এ রকমের নির্ভুল এবং ‘মুক্তোর মতো হরফে’ উত্তরপত্র হতো না। পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষার হলে এ রকমের উত্তরপত্র লেখা অত্যন্ত মেধাবীদের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাছাড়া মৌখিক পরীক্ষায় তো শারমিন আক্তার প্রমাণই করেছেন যে, এই চাকরিপ্রার্থীরা মোটেই মেধাবী নন। খাতায় তারা ‘মুক্তোর মতো হরফে’ যে উত্তরপত্র লিখেছেন সেটিই মৌখিক পরীক্ষায় লিখতে বলা হলে কিছুই লিখতে পারেননি! শারমিন আক্তার জাহানের এসব অভিযোগ যথাযথ তদন্ত করা হলে নিয়োগ কমিটির সভাপতি হাসান ইমাম, সদস্যসচিব আফম আখতার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা মূল্যায়নকারীরাসহ সবাই ফেঁসে যেতেন। এমনকি এই নিয়োগ দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতির সকল অপকর্মের হোতা, নেপথ্যের গডফাদার এপিএস আরিফও বাঁচতে পারতেন না। অনিয়মের সূত্র ধরে টান দিলে তার নাম আসতোই নিসঃন্দেহে। আর এ কারণেই শারমিন আক্তারের এতো গুরুতর লিখিত অভিযোগের পরও মন্ত্রণালয় তদন্তের কোনোই উদ্যোগ নেয়নি!
এমনকি পরবর্তীতে ৮ মার্চ নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব, অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রশাসন) আবুল হাশেম শেখ লিখিতভাবে ঘুষের প্রমাণসহ অভিযোগ দেয়ার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছে এবং ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে নিয়োগ দুর্নীতির এসব অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশ এবং টিআইবির বিবৃতিতে শাস্তি দাবির পর সকল মহলে যখন তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাধ্য হয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে। গত ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হক খানকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে দুই মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এপিএস আরিফুর রহমান এবং অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমামকে দুর্নীতির দায় থেকে বাঁচানোর জন্য তদন্ত কমিটির ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। আর এ কারণেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা যাচ্ছে না। নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব, উপপরিচালক (প্রশাসন) আবুল হাশেম শেখ এর অভিযোগ তদন্ত করতে গেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শ্রীনিবাস দেবনাথকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে এবং তার কললিস্ট খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ, তিনিই ডা. হাশেমের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাকে কোটি টাকা ঘুষ এবং পদোন্নতির অফার করেছিলেন। এমনকি এপিএস আরিফের সঙ্গেও কথা বলিয়ে এসব অফার কনফার্ম করে দিয়েছিলেন। এখন শ্রীনিবাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে এপিএস আরিফ নিঃসন্দেহেই ফেঁসে যাবেন। অন্যদিকে উপসচিব শারমিন আক্তারের লিখিত অভিযোগটি ছিলো নিয়োগ পরীক্ষার খাতা পরিবর্তন বা জাল-জালিয়াতি নিয়ে। এটি তদন্ত করতে গেলে পরিচালক (প্রশাসন) হাসান ইমাম নিশ্চিতভাবেই ফেঁসে যাবেন। কারণ তিনি নিয়োগ কমিটির সভাপতি, শুরুতে তাকেই জবাব দিতে হবে, নিয়োগ পরীক্ষার খাতা কীভাবে পরিবর্তন হলো, কীভাবে জাল-জালিয়াতি হলো। অবশ্য পরিস্থিতি বেগতিক দেখে হাসান ইমাম এখন নিজের দায় এড়ানোর জন্য গণমাধ্যমে নানা কথা বলছেন। তিনি উল্টো ডিজির ওপর এসবের দায় চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন, যদিও ডিজি অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিজে তৈরি করেননি, হাতে নিয়ে দেখেননি, লিখিত পরীক্ষার খাতার ধারেকাছেও যাননি, কারো জন্য তদবিরও করেননি অর্থাৎ নিয়োগ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন। বরং এটা স্পষ্ট যে, নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে ডিজি বার বার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, ক??
সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন