দেশে করোনার টিকার কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই সাড়ে ৪৮ লাখ মানুষ টিকা গ্রহণ করেছেন। টিকা গ্রহণকারীদের শরীরে কতোটুকু অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এবং এর কার্যকারিতা কতোদিন থাকবে তা নিয়ে গবেষণা করছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জানিয়েছেন, এই গবেষণার ফলাফল পেতে সময় লাগবে ২ বছর
। ২ বছর পর চূড়ান্ত ফল পেলেও এই গবেষণার অন্তর্বর্তী ফলাফল কয়েক মাস পর পর প্রকাশের চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার গঠিত কারিগরি পরামর্শক কমিটিও পরামর্শ দিয়েছে। টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে প্রত্যেক দেশে টিকা নিয়ে নিজস্ব গবেষণার পরামর্শ দিয়ে আসছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন মানবজমিনকে বলেছেন, করোনার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য দেশে গবেষণা শুরু হয়েছে।
এ ধরনের গবেষণার ফলাফল পেতে সময় লাগে। তাদের এই গবেষণার ফল হাতে পেতে ২ বছর সময় লাগবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ভ্যাকসিন নেয়ার পর মানুষের শরীরে কি রকম অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। টিকাটি নেয়ার কতোদিন পর অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে জানার দরকার আছে। টিকা কত মাত্রায় কার্যকর তা নিয়ে গবেষণা করছে আইইডিসিআর। দেশের এই বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট জানান, আইইডিসিআর এই নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। এই গবেষণায় ২ বছর সময় লাগবে বলে আইইডিসিআর জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এই ধরনের গবেষণায় ২ বছর সময় লাগবে। তবে কার্যকারিতার বিষয়ে সময়ে সময়ে সবাইকে তারা জানাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। যেমন ৩ মাস পর, ৬ মাস পর গবেষণায় তারা কী পেলেন তা জানাবেন। অ্যান্টিবডি কতোটুকু কার্যকর হলো এবং কতোদিন থাকছে তা সবাইকে জানাবেন। শুধু বিজ্ঞানীদের নয়, সবাই জানতে পারবেন। এটা বড় গবেষণা। ১০টি হাসপাতাল সেন্টার, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে এই গবেষণা হবে। কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে এই গবেষণা পরিচালনা করা হবে বলে এই বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেন।
করোনা সংক্রমণের এমন হার আতঙ্কের বিষয়: গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সিএমএসডি’র নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এলেও সমপ্রতি স্বাস্থ্যবিধি না মানায় এর সংক্রমণ বেড়েছে। সংক্রমণের এমন হার আতঙ্কের বিষয়। এ ছাড়া করোনা আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা এক অস্বস্তিতে আছি। আমরা বেড়ে যাওয়ার কারণটি দেখলাম- বেশির ভাগ সংক্রমণ হয়েছে যারা কক্সবাজার গেছে। সেখানে কেউ মাস্ক পরেনি ও স্বাস্থ্যবিধি মানেনি। যার ফলে সংক্রমণের শতাংশ দুই থেকে এখন দশে উঠে গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, কিছুদিন আগেও মৃত্যু যেটা তিন অথবা চারে ছিল, সেটা এখন ২৬-এ উঠে গেছে। এটা আতঙ্কের বিষয়। আক্রান্ত বাড়ার ফলে দেশের অনেক লোক কর্মহীন হয়ে যাবে।
৮ই এপ্রিল থেকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ শুরু: আগামী ৮ই এপ্রিল থেকে করোনা প্রতিরোধী টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। গতকাল সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপো-সিএমএসডি’র নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের কবে নাগাদ দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক্রমে ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের ব্যবধানে যেন করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়, সেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
প্রথম ধাপে যাদের টিকা দেয়া হয়েছে, আগামী ৮ই এপ্রিল থেকে পর্যায়ক্রমে তাদের দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এই দ্বিতীয় ডোজ টিকা পাওয়ার জন্য সবাই টিকাকার্ডে দেয়া মোবাইল নম্বরে এসএমএস পাবেন। এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। যাদেরকে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করেই পরবর্তী টিকা কার্যক্রম প্রসারিত করা হচ্ছে। তবে করোনা সংক্রমণের বর্তমান ঊর্ধ্বগতিতে কঠোর পদক্ষেপের যে স্বাস্থ্যবিধি রয়েছে, সেটাকে যেন কঠোরভাবে পালন করা হয়, সেদিকে জোর দিচ্ছি। ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, অত্যাবশ্যকীয় ছাড়া চলাচলকে সীমিত রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাকেই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। বর্তমান সময়ে তরুণরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং সেটা বৃটেনের নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্য কিনা, জানতে চাইলে অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, করোনাভাইরাস যেকোনো বয়সে যেকোনো মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। বৃটেনের ভ্যারিয়েন্ট যতটা বেশি নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে আমরা আমাদের জীবনাচরণ কীভাবে পালন করছি, তবে অবশ্যই বৃটেনের ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান সময়ে টিকা দেয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ৪০ বছর। এ বয়স আরো কমিয়ে আনা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত ৪০ পর্যন্ত থাকবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যারা আছেন, তাদের বয়সসীমা নির্ধারণ করা নেই। এই তালিকার সবাইকে যখন টিকা নিশ্চিত করা হবে, তখন বয়সসীমা আবারো নামিয়ে নিয়ে আসবো। ৪০-এর বেশি এবং অগ্রাধিকার তালিকাতেই প্রায় ৪ কোটি মানুষ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়ার জন্য। এরইমধ্যে যাদেরকে টিকার আওতায় নিয়েছি, তাদের নিশ্চিত করার পর বয়সসীমা নামিয়ে আনা হবে। তিনি জানান, ভ্যাকসিন এসেছে, টিকা নিচ্ছে মানুষ। টিকা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। বর্তমান সময়ে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কেন প্রশ্নে অধ্যাপক সেব্রিনা বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতেই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা পূর্ব শর্ত। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক সময় তার শৈথিল্য দেখা যায়। সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে এটা একটা বড় কারণ বলে আমরা মনে করি। এরইমধ্যে মাস্কের ব্যবহার এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের ধরন একেবারে স্বাভাবিক অবস্থার মতো ফিরে যাচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছি। তিনি বলেন, সুতরাং, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। টিকা দেই না দেই, মাস্ক পরতে হবে, সঠিকভাবে পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে এবং হাত ধোয়ার অভ্যাস চর্চা করে করোনাকে প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এখন করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কেবল বাংলাদেশেই নয়, পুরো পৃথিবীতেই তাই। নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
টিকার পরবর্তী চালান আসছে ২৬শে মার্চ: ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকার পরবর্তী চালান কবে আসবে জানতে চাইলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ২৬শে মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন। আমরা আশা করছি, তার সফরের সঙ্গে বা তার পরপরই সেরাম থেকে পরবর্তী চালান পাবো। তবে মার্চের চালান এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেও আসতে পারে- এমনটা হতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন