ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মঙ্গলবার বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ওপর হামলার ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন শীর্ষ নেতা দাবি করেন যে, ওই হামলার সঙ্গে তাদের কোনো ’সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতা’ নেই।
এমনকি তিনি কৌশলে সাধারণ ছাত্রদের উপর দোষারোপ করে বলেন, তারাই ছাত্রদলের ’অপরাধমূলক কার্যকলাপ’ প্রতিরোধ করতে ওই হামলা চালায়।
অথচ, ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা হামলায় তাদের ’সক্রিয় অংশগ্রহণ’ নিয়ে গর্ব করে একইদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি, ভিডিও এবং টেক্সট পোস্ট করেছেন।
তাদের একজন এমনকি একটি জাতীয় দৈনিকের ক্যাম্পাস সংবাদদাতার সঙ্গে সংবাদ প্রতিবেদনে হামলাকারী হিসেবে তার নাম উল্লেখ না করায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এই নেতাদের বেশিরভাগই সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল ইউনিটের বিভিন্ন পদে আছেন। তারা খারাপ কাজের জন্য হলেও মিডিয়া কাভারেজ পেতে চাইছেন। কারণ আর কয়েক মাসের মধ্যেই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। সেসময় সংগঠনে আরও ভাল অবস্থান পেতে তাদের এখন মিডিয়া কাভারেজ দরকার।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একজন নেতা বলেন, ’এ ধরনের হামলার সঙ্গে জড়িত কেউ যদি মিডিয়ার স্পটলাইট পায়, তাহলে সে একে ব্যবহার করে ভালো পোস্ট পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে’।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এক বৈঠক শেষে ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোকে পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এতে সংগঠনটরি মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে সংগঠনটির একটি সূত্র জানিয়েছে।
শিক্ষক ও কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা বলেন, সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো এমন কর্মীদের নির্বাচন করে যারা এ ধরনের হামলায় অংশ নিতে পারে।
এ কারণেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের এমন হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা বলে বড়াই করে ফেসবুকে হামলার ছবি পোস্ট করেন।
মঙ্গলবার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা, লোহার রড ও ছুরি নিয়ে ছাত্রদলের ওপর হামলা চালায়। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় এই হামলা চালানো হয়। হামলায় কয়েকজন নারী কর্মীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও ক্লিপগুলোতে দেখা গেছে, ছাত্রদলের নারী কর্মীদেরকেও ছাত্রলীগের পুরুষ কর্মীরা মারধর করছে।
হামলার পর অন্তত ১০জন ছাত্রলীগ নেতা ফেসবুকে তাদের ছবি আপলোড করে হামলায় তাদের জড়িত থাকার কথা লিখেছেন।
এদের মধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ইউনিটের সহ-সভাপতি সুরপ মিয়া সোহাগ এবং একই হল ইউনিটের যুগ্ম সম্পাদক আমির হামজাকে মঙ্গলবার তাদের আপলোড করা ছবিতে লাঠি হাতে দেখা গেছে।
আমির হামজা ওই হামলার সময় লক্ষণীয়ভাবে আক্রমণাত্মক ছিলেন। সংবাদ মাধ্যমে হামলার খবর আসার পর তিনি ডেইলি স্টারের এক সংবাদদাতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেনে, তিনি হামলার সময় ’সক্রিয়’ থাকলেও কেন সংবাদ প্রতিবেদনে তার নাম রাখা হয়নি।
আমির হামজা একটি জাতীয় দৈনিকের ওই সংবাদদাতাকে বলেন, ’আপনি যদি হামলার বিষয়ে কোনো রিপোর্ট করেন, তাহলে অনুগ্রহ করে আমার নামও লিখুন। এতে আমি দলে আরও ভালো পোস্ট পাব’।
আরেকটি জাতীয় দৈনিকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালেও আমির একই ধরনের মন্তব্য করেন বলে জানা গেছে।
এছাড়াও, কিছু নেতা তাদের ফেসবুক পোস্টে গর্বভরে ওই হামলায় তাদের ’অংশগ্রহণ’ সম্পর্কে লিখেছেন। তারা বলেন যে, তারা ছাত্রদলকে ‘সফলভাবে প্রতিহত করেছেন’।
এরা হলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাকিব হোসেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সেক্রেটারি আল আমিন রহমান, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সভাপতি রুবেল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন রানা, স্যার এএফ রহমান হলের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুনেম শাহারিয়ার মুন এবং কবি জসিমউদ্দিন হলের সভাপতি মো. সাধারণ সম্পাদক লুৎফুর রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিমুদ্দিন খান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এ ধরনের হামলাকে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পেশিশক্তি ব্যবহার করার সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করা কখনোই সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, ’মনে হচ্ছে ভালো রাজনীতির চেয়ে পেশীশক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আর এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতা আরও বেশি পেশি শক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, ’শাসকপন্থী ছাত্র সংগঠন রাজনীতিতে সব সময় পেশিশক্তি ব্যবহার করে... আমি হামলার সঙ্গে জড়িতদের, বিশেষ করে, নারীদের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করছি’।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা সাড়া দেননি।
ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ মোঃ আরিফ হোসেন বলেন, ’প্রতিপক্ষকে আঘাত করা আমাদের সংগঠনে অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয় না’।
তবে তিনি এও বলেন, ‘সঙ্কটের সময় যারা দলের সঙ্গে থাকে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়‘।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন