হঠাৎ করেই নগদ টাকার সঙ্কটে দেশের ব্যাংক গুলো। ব্যাংক পাড়ায় কান পাতলেই তারল্য সঙ্কটের কথা শোনা যায়। আরো শোনা যায় ব্যাংকের টাকা নামে-বেনামে লুটে নিচ্ছে শাসক পরিবার এবং তাদের অনুকম্পাপ্রাপ্ত একদল ব্যবসায়ী। প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিটেন্স ও জনগণের সঞ্চয়ের এই টাকা বিভিন্ন চ্যানেলে পাচার হচ্ছে বিদেশে। শাসক পরিবার তাদের পছন্দের তালিকায় থাকা আওয়ামী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী জনগণের কষ্টের টাকা নানা কৌশলে লুটে বিদেশে পাচার করছে। এই টাকার ঘাটতি মিটাতে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপে দেশের মানুষ।
অথচ, মাত্র ৬ মাস আগের গল্পটা এমন ছিলো যে, টাকা বিনিয়োগের যায়গা পাচ্ছে না দেশের ব্যাংকগুলো। তারল্য বা ব্যাংকের অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যেন ঘুম হারাম কেন্দ্রিয় ব্যাংকের। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো জুন ২০২১ শেষে ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্যের জোয়ারে ভাসছিল; যার মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা একেবারেই অলস পড়ে ছিল। তবে কয়েক মাস যেতে না যেতেই গল্পের চরিত্রটা বিপরীত হয়ে গেলো। ব্যাংকের টাকা সব যেন হাওয়া হয়ে গেছে।
এতো টাকা গেলো কোথায়? অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, গত ৬/৭ মাসে শাসক পরিবার ও শেখ হাসিনার আস্থাভাজন বড় বড় কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপকে অর্ধেক সুদে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। আর এর পেছনে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের যুক্তি ছিলো-স্থবির অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর। তবে বাস্তবে তা হয়নি। ব্যাংকের সব টাকা চলে গেলেও অর্থনীতিতে গতি ফেরেনি। এই ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে এখন বড় প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আছে, ঋণ যাঁদের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, তাঁরা কাঙ্খিত সেবা পাননি।
কেন্দ্রিয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। যা শতকরা হিসেবে ৪৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়লে মানুষের আয় বাড়ে। আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় করে। ফলে ব্যাংকে আমানত প্রবাহও বাড়ে। কিন্তু এখন ঘটছে উলটো ঘটনা। আমানত প্রবাহ না বেড়ে বরং কমছে। এটি অস্বাভাবিক। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গ্রাহকদের এসব টাকা কোথায় যাচ্ছে? প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ হলে সেটি ঘুরেফিরে ব্যাংকেই আসত। কিন্তু ব্যাংকে আসছে না।
ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকে আমানত কমলে সেগুলো যায় শেয়ার বাজার বা সঞ্চয়পত্রে। কিন্তু শেয়ার বাজারে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ যাচ্ছে না। সঞ্চয়পত্রেও বিনিয়োগ হচ্ছে না। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ২০ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
ব্যাংকে টাকার হাহাকারের মধ্যেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সরাসরি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট নিরসনে তফসিলি ব্যাংকগুলোর বিশেষ তহবিলের সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে বিএসইসি। এই নির্দেশনা পেয়েছে ২৮টি ব্যাংক।
যেসব ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে – ব্র্যাক ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ব্যাংক আল-ফালাহ, সিটি ব্যাংক এন.এ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ সিলন, হাবিব ব্যাংক, এইচএসবিসি, ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
এদিকে দেশের অনেক বেসরকারি ব্যাংকের হাতে সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণের মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এজন্য বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ রেপো ও অ্যাশিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) নিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এক্ষেত্রে সামনের সারিতে আছে দেশের চতুর্থ প্রজন্মের বেশ কয়েকটি ব্যাংক। তৃতীয় প্রজন্মের অনেক ব্যাংকেও শুরু হয়েছে তারল্য সংকট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে জমা হয়েছে রেকর্ড অলস তারল্য। অথচ বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যাংকে টাকা নেই। বেশি সুদে আমানত না নিয়ে কলমানি বাজার থেকে সস্তায় ধার নেয়ার নীতিতে চলছিল বেসরকারি অনেক ব্যাংকই। এখন অতিরিক্ত তারল্যের অধিকারী ব্যাংকগুলো ট্রেজারি নীতি বদলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে বেসরকারি বেশকিছু ব্যাংকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন