যুক্তরাষ্ট্রে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন মিল্কী হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামি সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলসহ (লাল বৃত্তে) অন্য নেতাকর্মীরা -যুগান্তর
আট বছরের বেশি সময় আগে রাজধানীর গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করে হত্যা করা হয় রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে। তিনি (মিল্কী) ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামি হলেন যুবলীগ মহানগর উত্তরের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে অংশ নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান যুক্তরাষ্ট্র সফরকে কেন্দ্র করে তিনি অন্য নেতাকর্মীদের চেয়ে বেশি সক্রিয়। প্রধানমন্ত্রীর পাশে তার ছবি দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ব্যানার টানিয়েছেন। যুবলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের সঙ্গে সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন সমানতালে। কোনো কোনো সমাবেশে তাকে মধ্যমণি হিসাবে দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় মিল্কীকে। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডের আসামিরা মিল্কীর বুকে কয়েক রাউন্ড গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে মোটরবাইকে করে পালিয়ে যায়। এ খুনের ঘটনায় নিহত মিল্কীর ছোট ভাই মেজর রাশেদুল হক খান বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর মিল্কী হত্যা মামলায় কেবল চঞ্চল একা পলাতক নয়। তার সঙ্গে পলাতক আছে আরও তিনজন। চার্জশিটভুক্ত বাকি ১৪ জন আছেন জামিনে। মামলার বিচার চলছে ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। এটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। মামলাটির প্রথম তদন্তের দায়িত্ব পান র্যাব কর্মকর্তা কাজেমুর রশিদ। ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল ১১ জনকে অভিযুক্ত করে তিনি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ওই চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি দেন মামলার বাদী। পরে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস অধিকতর তদন্তে আরও সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মনসুর রিপন বলেন, ‘মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি চঞ্চল বিদেশে পলাতক। একই সঙ্গে জামিনের শর্ত ভঙ্গ করে এ মামলার অন্যতম আরেক আসামি লোপাও এখন আর আদালত হাজিরা দেন না। আমরা শুনেছি, তিনি ভারতে আছেন।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী চঞ্চলকে দেশে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান যুগান্তরকে বলেন, যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি বিদেশে পলাতক আছে, তাদের সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এটা আমাদের চলমান প্রক্রিয়া। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবেই এটি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, চঞ্চলকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘চঞ্চল কোনো মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি নয়। কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাকে দোষী বলতে পারি না। সে অনেকদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। ২০০৯ সালে যারা আমাকে সম্মেলন করতে দেয়নি তাদের অর্থের জোগান দিয়েছে চঞ্চল। সে গত পাঁচ বছরে অনেক সভা-সামাবেশ করেছে। এতদিন কেন তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। এখন আমার মিটিং-মিছিলে যাওয়ার পর থেকেই তিনি ভাইরাল হয়ে যাচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তাকে কোনো কমিটিতে রাখিনি। কোনো সভায় সভাপতিত্বও করতে দিইনি। প্রথমদিকে দলীয় হাইকমান্ড থেকে তার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা আমার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তখন আমি তাকে পাত্তা দিইনি। এখন হাইকমান্ড তার ব্যাপারে পজিটিভ। তাই আমি তাকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দিচ্ছি।
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনের বক্তব্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, চঞ্চলকে যুবলীগ থেকে কখনো বরখাস্ত করা হয়নি। তাই তিনি এখনো যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। যারা তার বহিষ্কারের কথা বলছেন, তারা কাগজ দেখালে আমরা চঞ্চলকে দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেব না। ইতোমধ্যে দেশে চঞ্চলের ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয়েছে বলেও ড. সিদ্দিকুর রহমান জানান। তিনি আরও বলেন, যুবলীগ নেতা ইসমাইলকে যখন বিমানবন্দরে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়, তখন আমিও ছিলাম। এ সময় চঞ্চল এসে পাশে দাঁড়ায়। ছবি তোলার সময় কেউ পাশে দাঁড়ালে তো তাকে না বলা যায় না।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রোকশানা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, সাম্পতিক সময়ে দলীয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নেওয়া সংক্রান্ত চঞ্চলের ছবি এবং ভিডিও এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। তিনি জানান, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন চলতি মাসের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইসমাইল হোসেনকে বিমানবন্দরে ফুলেল শুভেচ্ছার মাধ্যমে রিসিভ করেন চঞ্চলসহ অন্য নেতাকর্মীরা। এই ছবিটিও ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রচার-প্রচারণায় চঞ্চল নিজেকে এখনো আওয়ামী যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেই পরিচয় দিচ্ছেন। শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টানানো ব্যানারেও তিনি এই পরিচয় উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল যুগান্তরকে বলেন, দলীয় কর্মকাণ্ডে হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামির অংশগ্রহণ কাম্য হতে পারে না। এটা কোনোভাবেই শোভন নয়। এর কোনো বৈধতা নেই। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। নিউইয়র্কে চঞ্চল যে যুবলীগ নেতার সঙ্গে ছবি তুলেছেন বা ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন সেই যুবলীগ নেতারও দায় আছে। তিনি আরও বলেন, কোনো রাজনৈতিক নেতা বিদেশ সফরে গেলে অনেক নেতাকর্মী তাকে রিসিপশন দেয়। এক্ষেত্রে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি সেখানে চলে গেলে তেমন কিছুই করার থাকে না। আর চঞ্চল যেহেতু দলের কেউ নন তাই এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে দলগতভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন