সচিবদের সভায় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। সচিব সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আলোকে সম্প্রতি সচিবদের কাছে ২০ দফা লিখিত নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে দুর্নীতির বিষয়টি স্থান পেয়েছে ১৭ নম্বরে। যেখানে শুধু এক লাইনে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
প্রশাসন সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সব উন্নয়নের একমাত্র বড় বাধা হলো দুর্নীতি। তাই দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর সামগ্রিক বক্তব্য কোড করে চিঠির প্রথম দফা নির্দেশনাতেই বিষয়টি যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। সচিবদের অনেকে বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তারা মনে করেন, এমনিতে নানাভাবে চেষ্টা করেও সে অর্থে দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী সবল বক্তব্যকে দুর্বল করে দায়সারা এই চিঠি তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে বলে তারা মনে করেন না।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী গত ১৮ আগস্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সভায় যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দুর্নীতি ও সুশাসনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বক্তব্য দেন। সভায় সিনিয়র সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৮৫ জন কর্মকর্তার প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে একজন সচিব বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টিতে সরকারপ্রধান সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও সচিবদের কাছে পাঠানো চিঠিতে তার প্রতিফলন নেই। বিশ দফা নির্দেশনার মধ্যে সতেরো নম্বরে কয়েকটি শব্দে দুর্নীতি প্রতিরোধের কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর বার্তাকে সঠিকভাবে বহন করে না।
অপর একজন সচিব বলেন, এই মুহূর্তে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। প্রকাশ্যে এটা কেউ স্বীকার করবে না। কিন্তু বাস্তবে এটা স্বীকার করে নিয়ে যদি কাজ করা যায় তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে। এ কারণেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে গিয়ে সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এত বেশি বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার পরও দুর্নীতি করলে সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি একটি ব্যাধির মতো, এই ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্ব সচিবদের। সরকারপ্রধান বলেন, আবাসন নির্মাণ ও গৃহঋণ দিচ্ছি, অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে নববর্ষ ভাতাও দেওয়া হচ্ছে, গাড়ি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ সময় হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেহেতু অনেক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি, দুর্নীতিকে সহ্য করব না, তা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। এবার সচিব সভায় চার বছর পর প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় প্রতি বছর উপস্থিত থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি যে কমেনি সে বিষয়ে গত সপ্তাহে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব প্রকাশ্যে বক্তব্য রেখেছেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দুদক সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ধারণা ছিল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্থকষ্টে থাকলে দুর্নীতি করবে। সেই ধারণা থেকেই তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাই পে-স্কেল প্রদান করেন। এরপরও দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয়নি।’
২০ নির্দেশনা : মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভালো কাজ করলে পুরস্কার প্রদান এবং অন্যায় করলে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু সরকারি কর্মচারী হিসাবে নয়, দেশপ্রেমিক নাগরিক ও জনগণের সেবক হিসাবে জনকল্যাণে আত্মনিয়োগে সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত ও কার্যকর করার জন্য সচিবদের আরও সজাগ হতে হবে।
সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির অপব্যবহার যাতে কেউ করতে না পারে সেজন্য চুক্তির শর্তাবলি বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চুক্তির অস্পষ্টতা পরিহারসহ নির্দিষ্ট সময় পরপর শর্তগুলো যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সময়োপযোগী করতে হবে। সীমিত কৃষি জমিতে বেশি ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সেখানে শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করতে হবে। তবে কারখানা স্থাপন করতে গিয়ে কৃষি জমি ও পরিবেশের ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজ করার সুযোগ আছে উল্লেখ করে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাত মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে হবে। নদ-নদী, খাল, হাওড়-বাঁওড়ে খনন, নাব্য পুনরুদ্ধার, দখলমুক্তসহ জলজ অঞ্চল তীরবর্তী ভূমি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। করোনাকালীন সময়েও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালু রাখতে হবে। একই সঙ্গে করোনা মোকাবিলায় সবাইকে একসঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। পুরাতন জেলখানার পাগলাগারদের কাছে যে সেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখা হতো সেটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
নবনির্মিত ফায়ার সার্ভিস স্টেশনগুলোর প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে ফসলের ন্যায্যমূল্য অর্জন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বেইলি রোডে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নির্মিত ‘শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের’ স্যুভেনির শপে পার্বত্য এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন হবে। পরবর্তী বছর থেকে একাধিক দিনের উদ্যোগে এমন সভার আয়োজন করা হতে পারে। ২২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সামরিক শাসনামলে জারিকৃত ৫১টি অধ্যাদেশ জরুরিভিত্তিতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আইনে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
নির্দেশনার বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন