পর পর তিন দিন কেন্দ্রীয় নেতাদের সভা করে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বিএনপি। দলটির নেতারা এই বৈঠকে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পাশাপাশি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
পাশাপাশি তাঁরা এ-ও বলেছেন, আন্দোলন কিংবা নির্বাচন যেটাই হোক নেতৃত্ব বিএনপিকেই দিতে হবে। এর ফলে বৃহত্তর ঐক্য গঠন হলেও নেতৃত্ব যে বিএনপির হাতে থাকছে, সেটি স্পষ্ট হয়ে গেল বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
kalerkanthokalerkanthoযদিও তিন দিনের ওই সভার মতামতের ভিত্তিতেই বিএনপি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। আজ শনিবার দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভায় দলের নির্বাহী কমিটির যেসব সদস্য বাকি রয়েছেন তাঁদের পাশাপাশি দলের জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে পৃথক সভা করার সিদ্ধান্ত হতে পারে। এ ছাড়া করণীয় নির্ধারণে সমমনা পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হতে পারে আজকের বৈঠকে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে করণীয় নির্ধারণে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত জানার জন্য গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিন দিন বিএনপির সভা দলের গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে স্কাইপের মাধ্যমে এতে সভাপতিত্ব করেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও এক দফার আন্দোলন শুরু হলে সবাইকে রাজপথে দেখতে চান বলে বৈঠকে জানান তারেক রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন দিনের ওই সভায় ১১২ জন নেতা বক্তব্য দেন। তাঁরা দলের বর্তমান নেতা তারেক রহমানের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। দু-একজন বক্তা আরো স্পষ্ট করে বলেন, নেতৃত্ব খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকেই দিতে হবে। অনেকের মতে, দলের ভেতরে-বাইরে নানামুখী গুঞ্জন থাকলেও এই সভার ফলে বিএনপিতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব আরো সংহত হলো। পাশাপাশি তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে এটাও স্পষ্ট হলো। তিন দিনে বিভিন্ন স্তরের মোট ২৭৬ জন নেতা সভায় অংশ নেন।
বিএনপির সুহৃদ হিসেবে পরিচিত গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, “তিন দিনের সভা করে তারেক রহমান একটা ভালো কাজ করেছেন। তবে ‘বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়।’ তারেক সবাইকে যদি আন্দোলনে উৎসাহিত করতে পারেন, তবে তাঁর নেতৃত্ব আরো সফল হবে।”
‘আমি তো তারেকের বিরুদ্ধে নই, আমি চাই বিএনপি নড়াচড়া করুক। এখন নড়াচড়া শুরু হয়েছে এটা ভালো; আন্দোলনে সফল হলে আরো ভালো,’ বলেন বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানই দল পরিচালনা করছেন। গত পাঁচ বছর তিনি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের খণ্ড খণ্ড বৈঠকেও অংশ নেন। তবে এই প্রথম কেন্দ্রীয় নেতাদের সভা মোকাবেলা করেন। ফলে দলের সর্বস্তরে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে বলে তিন দিনের ওই বৈঠকের পর বিএনপিতে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তারেকের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ওই বৈঠক থেকে মূলত তিনটি বিষয় গ্রহণ নিতে পারেন। প্রথমত, নেতাদের বক্তব্য থেকে সংগঠন গোছানোর উপাদান তিনি বেছে নিতে পারেন এবং সেটি তাঁকে করতে হবে এ বছরের মধ্যেই। কারণ সভায় দেওয়া বক্তব্যে দলের কোন স্তরে কী শূন্যতা আছে সেটি উঠে এসেছে। সভায় আন্দোলনমুখী নেতাদের গুরুত্ব দেওয়ারও দাবি এসেছে। দ্বিতীয়ত, কর্মকৌশল ঠিক করে আগামী ২০২২ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করা এবং তৃতীয়ত, পরের বছর ২০২৩ সালে নির্বাচন মোকাবেলা করা।
সভার শেষ দিনে উপস্থিত দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, বিএনপি এখন নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলবে না। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপি এখনই গ্রহণ করতে রাজি নয়। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে দলটি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এখন ইস্যু হলো আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানো।
সূত্র জানায়, সভায় নির্বাচন কমিশন নিয়েও বিএনপি এখন কথা বলতে রাজি নয় বলে জানান দলটির সিনিয়র নেতারা। সূত্র মতে, নির্বাচন কমিশনের বদলে সরকার বদলানো জরুরি বলে মনে করে বিএনপি। দলটির মতে, সরকার হটাতে পারলে নির্বাচন কমিশন এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
সভায় যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে বেশ জোরালো মতামত উঠে এলেও ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফন্ট বহাল রাখার পক্ষে জোরালো মতামত উঠে আসেনি। বরং জামায়াতকে ‘জোটে রাখা না-রাখা যাই হোক’ সেটা নিষ্পত্তির পক্ষে জোরালো মতামত এসেছে। নেতারা এমন মতামতও দিয়েছেন যে জামায়াতের সঙ্গে জোট করায় বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিন দিনের সভা থেকে কী পাওয়া গেল এমন প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তৃণমূলসহ সারা দেশে নেতারা কী ভাবছেন সেটি এই বৈঠকে উঠে এসেছে। পাশাপাশি সরকার পতনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে সে ব্যাপারেও মতামত পাওয়া গেছে।’
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন, ‘সংগঠন শক্তিশালী করা আন্দোলনের পূর্বশর্ত। সে বিষয়ের পাশাপাশি সমমনা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে—সভায় এমন মতামত এসেছে।’ স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মতে, ‘প্রথমত, তিন দিনের সভায় বিএনপি প্রচণ্ড চাঙ্গা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি যে ঐক্যবদ্ধ সেটি আবারও সুস্পষ্ট হলো।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এই সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়, সেই দাবিই প্রতিফলিত হয়েছে সভায়। তাই সরকার পতনের এক দফাই বিএনপির এখন প্রধান লক্ষ্য।’
বৈঠকে আরো যা পাওয়া গেল : নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ে সরকারবিরোধী এক দফা আন্দোলন ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়া, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনে না যাওয়া, আন্দোলনের জন্য দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা, জোটের নেতৃত্ব বিএনপির হাতে রাখা, বাম-ডানসহ সব দলের সঙ্গে কথা বলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং সবাইকে এক মঞ্চে আনা, সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত আন্দোলন করা, এখনই আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করা, আন্দোলনমুখী নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া এবং সব শেষে সভা থেকে শিক্ষা অর্জন ও দলের ভেতরে-বাইরে ঐক্য সৃষ্টি করার বিষয়ে নেতারা মতামত দেন।
জানতে চাইলে সরকারবিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফন্ট নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচন না করে সরকারবিরোধী আন্দোলন করার যে অবস্থান বিএনপি নিয়েছে তার সঙ্গে আমি একমত। কারণ এমন অবস্থান আমি আগেই নিয়েছি। ফলে বিএনপির সভার ফলাফল আমার ভালোই লেগেছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন