বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে মিল রেখে চলতে চায় বিএনপি। এই চিন্তা থেকে অতিমাত্রায় ‘ইসলামীকরণের’ দিকে ঝুঁকে পড়া দলটিকে মধ্যম পন্থায় ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছেন নেতারা। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কূটনৈতিক বিষয়ে দেখভাল করা দলের সিনিয়র কয়েক নেতার সঙ্গে সম্প্রতি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন। বিষয়টি নিয়ে আরও বৈঠক হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা মনে করেন, জনপ্রিয়তার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী নানা মহলের সমর্থন ছাড়া সরকার গঠন করা গেলেও টিকে থাকা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মিসরের সংগঠন ব্রাদারহুড তাদের কাছে বড় উদাহরণ। দলটির শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতা মনে করেন, দলের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল নেতার কারণে বিএনপি এখন জাতীয়তাবাদী ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের দল হিসেবে পশ্চিমাদের কাছে পরিচিত। এই পরিচিতি ভোটের মাঠে সুবিধা দিলেও বৈশ্বিকভাবে প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে দলটি। বিশেষ করে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব দেখা দেয়। ওই বছরই জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। ওই সরকারের আমলেই দেশের উত্তরাঞ্চলে জঙ্গি নেতা বাংলাভাইয়ের উত্থানেও জামায়াত কানেকশনসহ তাদের নানা নেতিবাচক কর্মকা-ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পায় বিএনপির জোট সঙ্গী জামায়াত। আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপি তার একক সত্তা হারিয়ে ‘বিএনপি-জামায়াত’ বা ‘বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত’ হিসেবে ব্র্যান্ডিং হয়। এ কারণে সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব দেশ বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে ছিল, জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়ায় তারাও গোটা প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ায়।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, জামায়াত সঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তাদের মতামত দিয়ে রেখেছেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সবুজ সংকেত পেলেই মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার মতামত দেবেন। বিষয়টি এক বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেন, শুধু ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধতাই নয়; কিছু কর্মকা-ের কারণে দীর্ঘদিনের বন্ধুদেশ চীনের সঙ্গেও বৈরী সম্পর্ক চলছে বিএনপির। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ঢাকায় তাইওয়ানের কনস্যুলার অফিস স্থাপনের অনুমতি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় চীন। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদেরই আবার দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করা হয়েছে। এটি চীনকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে।
দলটির দুজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপির সঙ্গে ভারতের একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর চীন সব সময় বিএনপির বন্ধুদেশ হিসেবে পরিচিতি ছিল। নানা কারণে উভয় দেশের সঙ্গেই আস্থাহীনতা তৈরি হয়। ভারতের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়তে বিএনপির দিক থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান এই নেতারা।
বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের এক নেতা বলেন, সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটির ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ওই বৈঠকে দলের মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সব সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিবসহ একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেওয়া কথা ছিল। মহাসচিব সেই অনুযায়ী তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু দল থেকে চূড়ান্ত চিঠি দেওয়ার সময় স্থায়ী কমিটির বড় একটি অংশকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের তালিকায় রেখে ২৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল প্রস্তুত করা হয়। এই তালিকারও ছয়জন অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। ওই নেতা মনে করেন, এটিও ভালো কাজ হয়নি।
এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি শুধু কূটনৈতিকভাবেই নয়, দেশের রাজনীতিতেও প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে মার খাচ্ছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুই মামলায় কারাগারে যান। কিন্তু দলীয়প্রধানকে মুক্ত করার চেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েই ব্যস্ত ছিল দলটি। গত বছর করোনার মধ্যে খালেদা জিয়ার সাজা সরকারের নির্বাহী আদেশে স্থগিত করা হলে তিনি শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান। দলটির নেতাদের ভাষ্য, কার্যত খালেদা জিয়া এখন গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন।
বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের প্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অনেকে মনে করেন বিদেশিরা আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে, তাদের সহযোগিতা নিয়ে আমাদের ক্ষমতায় যেতে হবে। বিদেশিরা কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া যে অবৈধ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিলÑ এ কথা বিদেশিরা পরিষ্কার করে বলেছেন। তারা সবাই বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি। কিন্তু আমরা কী করছি? আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমরা কী করতে চাই। আমরা কোন পথে যেতে চাই।
দলীয় নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে ধরনের কৌশল, যে মানের সাহসী নেতৃত্ব থাকা উচিত বিএনপিতে তার বড় অভাব। খালেদা জিয়াকে সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরাটা অনিশ্চিত। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা আমাদের সময়কে বলেন, তারেক রহমানকে আরও বেশ কিছুদিন চেয়ারপারসনের গাইডলাইন অনুযায়ী চলতে হবে। এখনো দেশি-বিদেশি সব মহলই মনে করে বিএনপি মানে খালেদা জিয়া। দেশি-বিদেশি নানা মহলে তার সম্পর্ক রয়েছে। ওই নেতা আরও বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক মেরুকরণের দিকে খেয়াল রেখেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
বিএনপির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, মামলা ও গ্রেপ্তার থেকে রেহাই পেতে অনেকেই সরকারের নানা পর্যায়ে আপস করে চলছেন। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাসেরও ঘাটতি রয়েছে। এই অবস্থায় যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তারেক রহমানকে ঘিরে দলের ‘লো প্রোফাইল’ নেতাদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন