ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের অর্ধেক সময় পার হয়ে গেছে। সে হিসাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর আড়াই বছর। বিগত সময়ে জাতীয় নির্বাচনের বছর দুয়েক আগেই আন্দোলন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা মেরুকরণ তৈরি হতো। কিন্তু করোনা অতিমারীর বাস্তবতায় এবার রাজনৈতিক মাঠের চিত্র ভিন্ন। মাঠের কর্মসূচি না থাকায় আন্দোলনের মাঠে একেবারেই অনুপস্থিত আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। তবে করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখেই এ সময়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ কষতে শুরু করেছে বিএনপি। পাশাপাশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কী হতে পারে, আন্দোলন ব্যর্থ হলে কী হবে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের ফল কী আসবে?- এমন নানা বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। যত দ্রুত সম্ভব আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর কথাও ভাবছে বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, আগামী নির্বাচন তাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। নবম, দশম ও একাদশ- এ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছে। ২০০৭ সাল অর্থাৎ ওয়ান ইলেভেন থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বেশকিছু নেতাকর্মী খুন ও গুম হয়েছেন।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের সময় বলেন, সোজা সরলভাবে বলি, এখন থেকে যদি সজাগ না হয় বিএনপির সবার কপালে দুঃখ আছে। বিএনপি কোনো রকম চেষ্টাই করছে না। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা দেখেছেন, খুবই খারাপ। সেখানে সরকার তাকে নিয়ে আরও খেলছে, ‘তাকে ক্ষমা চাইতে হবে’- এ ধরনের নানা কথাবার্তা সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে। অথচ বিএনপি কোনো প্রতিবাদই করছে না। প্রতিবাদ তো বক্তব্য না, মাঠে ময়দানে নেমে প্রতিবাদ করতে হবে। সবাই চুপ করে বসে আছে। এই করে কি কিছু করা যায়? বিএনপি ক্ষমতায় যাক বা না যাক সুষ্ঠু ভোট তো হতে হবে। সুষ্ঠু ভোটের জন্য সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। এটা বিএনপির দায়িত্ব।
গত শুক্রবার ভার্চুয়াল আলোচনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। এ জন্য তিনি তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির নেতারা মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ পরিকল্পনামাফিক ও যুক্তিসঙ্গতভাবে নিতে হবে। সফল হতে সঠিক কর্মসূচিও নিতে হবে। বিশেষ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দাবির ন্যূনতম হলেও দৃশ্যমান সফলতা বিএনপিকে দেখাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, বিএনপির দেশে যারা আছেন, তারা তো কোনো নেতৃত্ব দিচ্ছেন না। তারা শুধু তারেক জিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এ মুহূর্তে তারেকের কিছুই করার নেই। তারেকের উচিত তার মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমানকে দেশে পাঠানো। তৃণমূলের মানুষ কার সঙ্গে কথা বলবে? তৃণমূলের নেতা খালেদা জিয়া তো বন্দি। তারেক রহমান লন্ডনে, তৃণমূল তাদের ক্ষোভ, দুঃখ কার সঙ্গে শেয়ার করবে? ফোনে এটা হয় না।
তবে বিএনপি নেতারা মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আন্দোলনে সফল হওয়া খুবই কঠিন। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে এর বিকল্পও নেই। কিন্তু আন্দোলনে ব্যর্থ হলে দ্বাদশ নির্বাচনও আগের মতো একতরফা হওয়ার ‘ঝুঁকি’ রয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তারা কোন দিকে ঝুঁকে আছে তাও দেখতে হবে। দলের অনেকে মনে করেন, বিএনপিকে নিয়ে এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। জিয়া পরিবার মাইনাস বিএনপির ষড়যন্ত্র থেকে বের হয়নি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে সতর্ক করে বলেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে। গণতন্ত্র ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র আমাদের সামনে আরও আছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দেন তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অপপ্রচার হবে। তবে কোনোভাবে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। আমরা আমাদের কৌশল নির্ণয় করি। কাজটি সততার সঙ্গে করি। সফল হবই।
তবে দলের একাধিক নেতা বলেন, শুধু পরামর্শ দিলেই হবে না। বাস্তবতাও থাকতে হবে। বিএনপি ও জিয়া পরিবার বিষয়ে সরকারের মনোভাব অর্থাৎ দেশে এলে জাইমাকেও যদি কোনো মামলায় আসামি করে গ্রেপ্তার করা হয়- এ শঙ্কা তো আছেই। তা হলে জাইমার দেশে এসে লাভ কী?
দলটির নেতারা মনে করেন, সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক সংবাদে বিএনপি ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে একজন সিনিয়র নেতার করা বক্তব্য এবং জাতীয় প্রেসক্লাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য নিয়ে দলে তোলপাড় অবস্থা চলছে। গণমাধ্যমে দেওয়া সিনিয়র ওই নেতাকে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
দলের একাধিক নেতা মনে করেন, দলে এখন যা কিছু হচ্ছে, দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। দেশি-বিদেশি কিছু শক্তির কাছে তারেক রহমান পুরোপুরি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ জন্য দলের কূটনীতিক উইংয়ের পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন নেতারা।
বিএনপির রাজনীতি পর্যালোচনা করেন- এমন বিশ্লেষক ও দলের বেশ কয়েকজন নেতা বলেছেন, দ্বাদশ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, নানা মহল থেকে নানা প্রস্তাব আসবে, চাপ আসবে কিন্তু তা মোকাবিলা করার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনে বিএনপি কোন পথে থাকবে।
এ প্রসঙ্গে গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, সরকার আরেকটি পাতানো নির্বাচন করতে পারে। এ সময়ে আমাদের ওপর টোপ ও চাপ আসতে পারে। সেই চাপে আমরা যেন ক্লান্ত না হই।
এদিকে, এরই মধ্যে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করেছে দলটি। সিপিবিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে থেকে বিরত রয়েছে। যার কারণে উপনির্বাচনে ক্ষমতাসী দলের বেশ কয়েকজন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। উপনির্বাচনেই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিলেট-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শফি আহমেদ। যদিও তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। কিন্তু দ্বাদশ নির্বাচনে শফির মতো নেতারা যদি দলের সিদ্ধান্ত না মেনে প্রার্থী হন, তা হলে বিএনপিকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হবে- এই নিয়েও চিন্তা কম নয় দলটির নেতাদের।
দলের নেতারা মনে করেন, বর্তমান সরকার ও কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার যে সিদ্ধান্ত দল নিয়েছে- এ সিদ্ধান্তের বিপরীতে বিএনপিকে তার পরিকল্পিত গাইডলাইনও তৈরি করতে হবে। আগামী বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির মূল দাবি নিরপেক্ষ সরকার। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে যদি রাজনৈতিকভাবে দলটি সফল হতে না পারে সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ সরকার দাবি আদায় করা বিএনপির জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হলে দ্বাদশ নির্বাচন কী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বর্জন করবে? এ প্রশ্ন এখনই নেতাদের চিন্তায় চলে এসেছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহাজাহান আমাদের সময়কে বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক- এটা দেশের সব দল মতের দাবি। কারণ দেশের মানুষের ভোটাধিকারের যে ক্ষমতা, সরকার পরিবর্তনের যে পদ্ধতি- তা এ আওয়ামী লীগ সরকার পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা মনে করি, আগামী দিনে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে রাজপথের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ ফিরে আসবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন