বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদল ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আরও স্তিমিত হয়ে পড়ছে। ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন ফজলুর রহমান খোকন এবং সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল। এর প্রায় তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর পর গত ১৮ মাসেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি সংগঠনটি। নতুন কমিটি হওয়ার পর ছাত্রদল বেশ জেগে উঠেছিল। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে বিলম্ব, অতিমাত্রায় গ্রুপিংয়ের কারণে সংগঠনে অনৈক্য দেখা দেয়। চলতি বছর পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবিতে দুই দফা নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সমানে অনশনও করেছেন ছাত্রদলের পদপ্রত্যাশীরা। এই নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দোহাই দিয়ে যে যার মতো করে সংগঠন চালাচ্ছে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, ছাত্রদলে এখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে সংগঠনের প্রতি কমিটমেন্ট নেই। তারা পদ পাওয়ার পর সংগঠনের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব শুরু করে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি যখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মার খেল, তখন ছাত্রদলের অন্যরা কোথায় ছিল?
সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রদলের ওপরও। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিল ছাত্রদল। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে ফেরেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কেন্দ্রীয় নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, সমন্বয়হীনতা আর ‘সিন্ডিকেটের’ কারণে আবারও ক্যাম্পাসে অবস্থান হারাতে বসেছে ছাত্রদল। দীর্ঘদিনের লুকায়িত এসব সমস্যা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর পরও এসব সমস্যা সমাধান না করে ‘অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার নীতি’ অনুসরণ করছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল বলেন, আমাদের মাঝে অতীতে যাই কিছু থাকুক না কেন, বর্তমানে ছাত্রদলে কোনো গ্রুপিং-সিন্ডিকেট নেই। পছন্দ-অপছন্দের কারণে একেকজন একেকজনের সঙ্গে রাজনীতি করে। এটিকে গ্রুপিং বলা যাবে না।
জানা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলে এখন পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া অন্য তিনটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক আমিনুর রহমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল। বিভিন্ন ইউনিট কমিটিতে ‘পদ ভাগাভাগির’ ক্ষেত্রে এই গ্রুপিং সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতিটি পক্ষ আবার সাবেক ছাত্রদল নেতাদের অনুসারী। আর সংগঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হিসেবে বিবেচিত ঢাবি শাখায় গ্রুপ রয়েছে ছয়টি।
ছাত্রদলের কোন্দল আরও দৃশ্যমান হয় ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাবি ইউনিটের ৯১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর। এটিকে ‘পকেট কমিটি’ অ্যাখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নামেন পদবঞ্চিতরা। অভিযোগ ওঠে, এই কমিটির আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সদস্য সচিব আমানউল্লাহ আমানসহ ৪৭ জন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারী। কমিটি ঘোষণার পর ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিনের সামনে সাত দিনে অন্তত পাঁচ দিন, চন্দ্রিমা উদ্যানে দুবার ও নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে একাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মধুর ক্যান্টিন এলাকায় দুবার সংঘর্ষে জড়ায় তারা। এতে নেতৃত্ব থাকা ও বঞ্চিত- উভয় পক্ষের একাধিক নেতাকর্মী আহত হন।
কোন্দল-গ্রুপিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, ছাত্রদল একটা পরিবারের মতো। পরিবারের মধ্যে যেমন নানা ঝামেলা হতে পারে, তেমনি একসঙ্গে রাজনীতি করার কারণে নিজেদের মধ্যে মাঝেমধ্যে একটু ঝামেলা হয়। কিন্তু এটা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বর্তমানে ছাত্রদলে কোনো কোন্দল নেই। আমরা সবাই সুসংগঠিত হয়ে গণতন্ত্র উদ্ধার এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আন্দোলন করে যাচ্ছি।
মেয়াদোত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটি ঢাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ ছিল তিন মাস। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর কমিটি ঘোষণার দিন হিসেবে তা মার্চেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। এ কমিটি তাদের মেয়াদের শেষ দিন সম্মেলন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হলে কমিটি ঘোষণা করে। সংঘর্ষের আশঙ্কায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। এ ছাড়া নেতাকর্মী সংকটের কারণে মেয়েদের পাঁচটি হলের একটিতেও কমিটি দিতে পারেনি ছাত্রদল।
ঢাবি ছাত্রদলের সদস্য সচিব আমানউল্লাহ আমান বলেন, আমাদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে কিন্তু দলের ক্ষতি হয় এমন কোনো গ্রুপিং নেই। ঢাবির মেয়াদোত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটি সম্পর্কে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল বলেন, অনেক জেলা-উপজেলা ছাত্রদলের কমিটি আছে ২০০১ সালে করা। আমরা তাই আগে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলায় কমিটি দিচ্ছি। এগুলো শেষ হলেই ঢাকার ইউনিটগুলোর কমিটি দেব। তখন ঢাবিতেও কমিটি হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন