শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতি-২৯
আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমত পোষণ করলেই জেল-জুলুম থেকে শুরু করে গুম ও ক্রসফায়ার এখন নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শেখ মজিবুর রহমানে আমলে সিরাজ সিকদারকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার যে ধারা শুরু করা হয়েছিল, তা বহাল রেখেছেন শেখ হাসিনা।
গত এক যুগের ফ্যাসিবাদী আমলে বিরোধী দলের শত শত কর্মীকে ধরে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পাশাপাশি গুমও করেছে শেখ হাসিনার সরকার। যাদের বেশিরভাগের খোঁজ আর মেলেনি।
“শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতি” শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজকে তুলে ধরা হয়েছে তেমনই এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তরিকুল ইসলাম ওরফে তারা মিয়ার গুমের কথা। ছাত্রদলের এই নেতাকে ৮ বছর আগে গুম করা হয়েছিল। তারার অপেক্ষায় এখনও আছেন স্বজনরা। কিন্তু, তারার খোঁজ আর মেলেনি।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে নির্মম দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয় আওয়ামী লীগ। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে যখন দেশের মানুষ সরব, তখন নীলনকশা করে বেছে বেছে গুম করা হয় প্রভাবশালী ছাত্রদল নেতাদের। তাদেরই একজন তারা মিয়া।
রাজধানীর পল্লবী এলাকায় স্ত্রীসহ বসবাস করতেন তারা মিয়া। দলীয় সব কর্মসূচিতে ছিলো তার সরব উপস্থিতি।
র ্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের অত্যাচারে যখন পল্লবীর মতো জনবহূল এলাকায় ছাত্রদল প্রায় কোনঠাসা, তখন সংগঠনকে গোছাতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। আর এতেই সরকারের নজরে পড়ে যান তিনি।
কীভাবে তুলে নিয়ে যায় তাকে?
২০১২ সালের ১২ আগস্ট। আর মাত্র তিন দিন বাদেই শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন যখন এই দিনকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত, তখন তারা মিয়া ছাত্রদলকে গোছাতে চষে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন অলিতে-গলিতে।
নীলনকশা অনুযায়ী ১২ আগস্ট পল্লবীতে তাদের নিজ বাসায় পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্য পরিচয় দিয়ে ঘেরাও করা হয়। ‘ঠক ঠক ঠক’ দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়তে থাকে শেখ হাসিনার দলবাজ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এ সময় ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলে হুড়মুড় করে ভেতরে অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়েন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ‘তারা মিয়া কোথা?’ কেউ একজন হাঁক ছাড়েন। এ সময় বাসার ভেতর এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন তারা।
ছাত্রদল নেতা তারা মিয়া এগিয়ে এলে তাকে সাথে সাথে পাকড়াও করে পুলিশের লোকেরা।
‘জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেব’ এটা বলে তারা নিয়ে যায়। এরপর আর তারা মিয়ার খোঁজ মেলেনি। এমনকি তারা মিয়াকে নিয়ে যাওয়ার কথাও স্বীকার করেনি কেউ।
তারা মিয়ার স্ত্রী যা বললেন:
তারা মিয়ার স্ত্রী বেবি জানান, তার স্বামীর বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় কোনো সাধারণ ডায়রি পর্যন্ত ছিলো না। তার অপরাধ একটাই সে ছাত্রদল করতো। তাই তাকে তুলে নিয়ে গেল।
তিনি বলেন, পরে থানায় যোগাযোগ করা হলে তারা সব অস্বীকার করে। তাদের দাবি, তারা এমন কোনো টিম পাঠায়নি। গুম করার পর উল্টা আমাদেরকে বিভিন্ন সময় এটা চাপ দেয়া হয়েছে যে, আমরা নাকি ইচ্ছা করেই তাকে লুকিয়ে রেখেছি।
গুমের রাজনীতি আ'লীগের হাতেই:
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরপর এদেশে গুম-খুনের রাজনীতি শুরু করে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনাও ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী মতামতকে শক্তভাবে দমন করতে একই পথ বেছে নেন। চিলির সাবেক স্বৈরশাসক পিনোশে’র কায়দায় একের পর এক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় চালিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনার সরকার।
যখনই কেউ কথা বলা শুরু করে তখনই শুরু হয় গুম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর ফিরে আসছে না তারা। ফলে ভয়াবহ এক ট্রমার মধ্যে দিন পার করছেন স্বজনরা।
গত এক যুগে শুধুমাত্র ভিন্নমত এবং ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তা পোষণ করার কারণে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষকে মামলার আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি। এই সময়ে মামলা দেয়া হয়েছে এক লাখ আট হাজার চৌদ্দটি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সরকার এবং আওয়ামী লীগের হাতে মারা গেছেন ১৫২৬ জন। গুম হয়েছেন বিএনপির ৪২৩ জনসহ সর্বমোট ৭৮১ জন। হালনাগাদ পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও, সন্তানদেরকে তাদের পিতার জন্যে, মাকে তার সন্তানের জন্যে কাঁদতে হচ্ছে। গোটা বাংলাদেশে এমন একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, মানুষ তার কোনো অধিকারই পাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জোর করে নির্বাচনে সমস্ত ভোট নিয়ে গেছে এবং বেআইনিভাবে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যেই তাদেরকে এই বেআইনি কাজগুলো করতে হচ্ছে।
এমনকি আলেমদের ওপরও নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাবিত সেক্যুলার এই সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকার শুধুমাত্র ভোট লুটই করেনি, গত এক যুগে তারা দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে ফেলেছে। শেয়ার মার্কেট লুট করে নিয়েছে। ব্যাংক লুট করে নিয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যে কোনো মানবাধিকার প্রচলিত আছে সেটা বলা যাবে না। প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘণ করা হচ্ছে।
গুম হওয়া পরিবারের একজন বলেন, গুমের শিকারদের স্বজনদের আন্দোলনে নামতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে স্বজনরাই কঠোর আন্দোলনে নেমে সফল হয়েছে। আমাদের দেশেও তাই করতে হবে।
তিনি বলেন, স্বজনদের এই সংগ্রাম বন্ধ হলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরে আসার সম্ভাবনার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন