প্রায় এক দশক আগে ব্যবসার জন্য কৃষি ব্যাংক থেকে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতা। ঋণ পরিশোধ না করায় দুই বছর পর অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়েছিল। ওই টাকায় নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনও মামলা করে। কিন্তু দুটি মামলার কোনোটি নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই কৃষি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই ঋণের প্রায় ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে। অবৈধভাবে এই সুদ মওকুফের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। বিএনপির এই নেতার নাম মোহাম্মদ আলী আব্বাস। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হলো মেসার্স আব্বাস ট্রেডিং। কৃষি ব্যাংক সূত্র, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন এবং মামলার এজাহার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী থানাধীন খোয়াজনগর এলাকার মোহাম্মদ আলী আব্বাস চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। বর্তমানে দলের কোনো কমিটিতে নেই তিনি। একসময় পাথরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন। আন্দরকিল্লায় তাঁর মালিকানাধীন আব্বাস ট্রেডিংকে ভোগ্য পণ্য আমদানির জন্য ঋণ দেওয়া হয় ২০১১ সালে। পণ্য এনে বিক্রির পর ঋণ পরিশোধের কথা থাকলেও ১০ বছরেও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেননি আব্বাস। নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে এই টাকা রূপান্তর করা ও অর্থপাচারের অভিযোগে ২০১৩ সালে কোতোয়ালি থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই মামলায় কারাগারে যান আব্বাস। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। মামলাটি এখন মহানগর বিশেষ আদালতে বিচারাধীন।
একই অভিযোগে ওই বছর কৃষি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আব্বাসের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সেই মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি। এ অবস্থায় ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফের তথ্য জেনে বিস্মিত হয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হক। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘সুদ মওকুফ কিভাবে হলো সেটা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। তবে দুদকের মামলা চলবে এবং অর্থপাচারের মামলায় দোষী ব্যক্তিকে অবশ্যই আইনগত শাস্তি ভোগ করতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আব্বাস ট্রেডিংকে ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি ৮৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় কৃষি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা। ঋণ পেতে ইমারতসহ জমি বন্ধক রাখার কথা ছিল। কিন্তু আব্বাস ব্যাংকে ৩.৭৫৫ একর নালজমি বন্ধক দিয়েছেন, যার বাজারমূল্য ছয় কোটি ১৪ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে সুদ মওকুফের সময় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংকের কাছে আব্বাস ট্রেডিংয়ের বন্ধককৃত জমির প্রকৃত মূল্য সেটাই দেখানো হয়। ব্যাংকাররা বলছেন, এটা ঋণের শর্তের পরিপন্থী।
অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল অনুসন্ধান করে চলতি বছরের ২১ মার্চ প্রতিবেদন দেয়, যা কালের কণ্ঠ’র হাতে আছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকের প্রকৃত ব্যবসার পরিসর বিবেচনা না করে সম্পূর্ণ নতুন একজন গ্রাহককে অত্যধিক ঋণসীমা প্রদানের মাধ্যমে গ্রাহককে খেলাপি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার বিআরপিডি সার্কুলার-৫ অনুসারে ঋণ পুনঃ তফসিল সুবিধা দেওয়ার তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ের মধ্যে চলমান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের জন্য যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা থাকলেও তা স্থগিতের ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, আব্বাস ট্রেডিংকে নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিবেচনার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আব্বাস ট্রেডিংয়ের ঋণ মওকুফের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার সঙ্গে লেনদেন শুরু করে আব্বাস ট্রেডিং। ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখা ও বিভাগীয় কার্যালয়ের সুপারিশে ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধান কার্যালয় আব্বাস ট্রেডিংয়ের নামে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে। এ ক্ষেত্রে ইমারতসহ ভূমির মূল্যমান ৪১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করে যথাযথভাবে বন্ধকি দলিল সম্পাদন করার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে গ্রাহককে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যমানের স্থায়ী আমানত হিসাব খোলার শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আব্বাস ট্রেডিং ওই শর্ত পূরণ করেনি।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩০ জুন বিএনপি নেতা আব্বাস ঋণের সুদ মওকুফের আবেদন করেন। কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় বিআরপিডি সার্কুলার-৫-এর আওতায় সুদ মওকুফের জন্য ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৭৪০তম সভায় কার্যপত্র উপস্থাপন করে। সভায় অনারোপিত সুদের ১০০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৭ কোটি কোটি ৬৯ লাখ ৯৪ হাজার এবং স্থগিত সুদ ৪১ লাখ ৪২ হাজারের অর্ধেক ২০ লাখ ৭১ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ৪৭ কোটি ৯০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা সুদ মওকুফ করা হয়। অবশিষ্ট পাওনা ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে মোট ৩৬টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনে অনিয়মের মাধ্যমে ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফের প্রমাণ পাওয়ায় একটি কমিটি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই কমিটিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের প্রতিনিধি আছেন। কমিটি অনিয়ম চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক শাহাদত হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা শোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। তবে ঋণটি এরই মধ্যে পুনঃ তফসিল করা হয়েছে।’
আব্বাস ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী আব্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঋণ পুনঃ তফসিল হওয়ার পর এরই মধ্যে দুই কিস্তির টাকা পরিশোধ করেছি। পুনঃ তফসিলের শর্তানুযায়ী বাকি টাকাও শোধ করা হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন