বিদায়ি বছরের প্রথম ৯ মাসেই ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ থেকে নতুন অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় ৭৪৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ২০ বছরে ব্যাংক খাতে ঋণ অবলোপনের অঙ্ক ৬১ হাজার কোটি টাকা ছুঁইছুঁই করছে।
দীর্ঘ এ সময়ে আদায় মাত্র ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে অবলোপন স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে কাগজেকলমে কম দেখানো হচ্ছে খেলাপি ঋণ। সেজন্য অবলোপন করছে ব্যাংকগুলো।
এতে ব্যাংকের খাতা সাময়িক পরিষ্কার দেখালেও প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহক। কারণ, খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার কারণে বাইরে থেকে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখায়। বাস্তবে এর উলটো। ঋণ অবলোপন একটি বৈশ্বিক পদ্ধতি হলেও এখানে এর অপব্যবহার বেশি হয়। অতি যত্ন এবং গুরুত্বের সঙ্গে এসব ঋণ আদায়ের কথা থাকলেও প্রকৃত আদায়চিত্র তা বলে না। কারণ অবলোপনের তুলনায় আদায় খুবই সামান্য।
বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিরা অবলোপনের টাকা দিতেই চান না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় ব্যাংকের মূলধনও শেষ হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক যুগান্তরকে বলেন, ঋণ অবলোপন থেকে আদায় জোরদার করতে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোর সমঝোতা স্মারক সইয়েও তা উল্লেখ করা আছে। এরপরও সময়ে সময়ে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। আশা করি, আদায়ে আরও গতি আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন করে ঋণ অবলোপন হয়েছে ৩৭৯ কোটি টাকা। ফলে অবলোপন করা ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি ৬০ হাজার ৭৮১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ তিন মাসে আদায় হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। ফলে সুদসহ পুঞ্জীভূত আদায় স্থিতি ১৭ হাজার ২২৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
এ অঙ্ক বাদ দিলে অবলোপনের বর্তমান স্থিতি ৪৩ হাজার ৫৫৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আর ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকের স্থিতিপত্রে থাকা খেলাপি ঋণের অঙ্ক ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৯৫৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুঞ্জীভূত অবলোপনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় আছে ২৩ হাজার ২১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে আদায় মাত্র ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের পুঞ্জীভূত ঋণ অবলোপন ৬৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আদায় ৩৫৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পুঞ্জীভূত ঋণ অবলোপন ৩৫ হাজার ৪৭৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ খাতের ব্যাংকগুলো এ পর্যন্ত আদায় করেছে ১১ হাজার ২১০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকে ১ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা অবলোপনের বিপরীতে আদায় মাত্র ২৫৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন বেশি করেছে। তিন মাসে ৩৭৯ কোটি ৯ লাখ টাকা ঋণ অবলোপনের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই ৩২৮ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের ৩৩ কোটি।
বিদেশি ব্যাংকের ১৭ কোটি। বেসরকারি ব্যাংকের মাত্র ২ লাখ টাকা। তবে এর আগের প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংক ঋণ অবলোপনে এগিয়ে ছিল। তখন তিন মাসে ৫৪৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণ অবলোপনের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকেরই ছিল ৪৫৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বিদেশি ব্যাংকের মাত্র ৫৩ লাখ টাকা। এছাড়া গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ঋণ অবলোপন হয়েছিল ৫২৯ কোটি টাকা।
জানা যায়, ব্যাংকের যে মন্দমানের খেলাপি ঋণ তিন বছর চেষ্টা করেও আদায় করা যায় না, তা মূলত লেজার বুক থেকে বাদ দিয়ে অন্য খাতায় লেখার নাম ঋণ অবলোপন। এর আগে অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা এবং অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ঋণগ্রহীতা পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত খেলাপি হিসাবে বিবেচিত হন। তবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে তা দেখানো হয় না।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ অবলোপনের নীতিমালা আরও শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে মামলা ছাড়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপন করা যেত। এখন তা পাঁচ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন