করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় বিশেষ ছাড়ের মধ্যেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি লাগামহীন হয়ে পড়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। রোববার প্রতিবেদনটি অনুমোদন করা হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ কমাতে ঢালাও সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনার কারণে গেল বছরও ঋণ পরিশোধে ছাড় ছিল। এছাড়া ঋণ পুনঃতফশিল, পুনর্গঠনসহ নানান ছাড়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার অনেক গ্রাহকের আবেদনে উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি না দেখানোর ওপর আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে আরও প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা। এছাড়া উচ্চ আদালতে অনেক ঋণ রিট করে নিয়মিত রাখা হয়েছে। ফলে আসলে কত টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে অনেক বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংক খাতের সঠিক হিসাব করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির সময় ব্যাংক ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে দেওয়া বিশেষ ছাড় ও সুবিধা এ বছরের শুরুতে কিছুটা তুলে নেওয়া হয়। তবে এখনো কিছু খাতে ছাড় রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ খেলাপি। যা এ যাবৎকালের এটাই সর্বোচ্চ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির অংক ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ল ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা। তবে গত বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে খেলাপি ঋণ ৩৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারির করোনার সময় অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় গত দুই বছর কোনো টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপি হয়নি। এ সুবিধা গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী করে তুলেছে। এ পরিস্থিতিতে অবস্থায় গত জুলাইয়ে নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসে খেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা হালনাগাদ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে যেখানে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউনপেমেন্টের অর্থ জমা দিতে হতো। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে। এসব কারণে ঋণ শোধ না করে খেলাপিরা বিশেষ ছাড়ের অপেক্ষায় আছে।
হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি দুই হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ চার হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এ অংক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এদিকে দেশের ব্যাংক খাতের লাগামহীন খেলাপি বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। আইএমএফের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির প্রধান রাহুল আনন্দ। বৈঠকে আইএমএফের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে? খেলাপি কমাতে কি উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? খেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে কিনা-এসব বিষয়ও জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। এসময় ব্যাংকিং খাতে সুশাসন (বাসেল-ত্রি), খেলাপি ঋণ সংজ্ঞায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী করার তাগিদ দেয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন