করোনায় ব্যাংকিং খাতের ঋণ আদায়ের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। এ সময়েও ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া চলমান আছে। তবে নিয়মিত ঋণ থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি পাঁচ ব্যাংক। একই সময়ে খেলাপি ঋণ থেকেও কোনো টাকা আদায় করতে পারেনি আরও পাঁচ ব্যাংক। এ ছাড়া নিয়মিত এবং খেলাপি ঋণ থেকে আদায় এক শতাংশেরও কম-এমন ব্যাংকের সংখ্যা ২১টি। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের এই চিত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ আদায় সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা খুব অস্বাভাবিক ঘটনা। একই সঙ্গে উদ্বেগেরও। এভাবে ঋণ আদায় বন্ধ হয়ে গেলে তা হবে ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনিসংকেত।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, তিন মাসে এক টাকাও আদায় হয়নি। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা। যত সমস্যা থাকুক পুরোপুরি ঋণ আদায় কখনো বন্ধ থাকার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বসা উচিত। কেন এমন হলো জানা দরকার। সমস্যা শনাক্ত করে তা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে জুন পর্যন্ত ঋণস্থিতি ১০ লাখ ১৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এ সময় খেলাপি ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিন মাসে ব্যাংকগুলো আদায় করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র ১৭৯৫ কোটি টাকা যা পুরো খেলাপি ঋণের ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত খেলাপি গ্রাহকদের থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি এমন ব্যাংকের সংখ্যা পাঁচটি। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশি সিটিব্যাংক এনএ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংক, উরি ব্যাংক এবং দেশি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এ ছাড়া নিয়মিত ঋণ থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক। তবে কমিউনিটি ব্যাংক নামমাত্র টাকা আদায় করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৬৫৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুনে ব্যাংকটির আদায় হয়েছে মাত্র দুই কোটি ৫৯ লাখ টাকা যা খেলাপি ঋণের ০.৪%। বেসিক ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৮ হাজার ৮১ কোটি টাকা, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত খেলাপি থেকে আদায় মাত্র ০.২% যা ১২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া উল্লিখিত সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোও খেলাপি গ্রাহক থেকে ১ শতাংশের বেশি আদায় করতে পারেনি।
অন্য দিকে খেলাপি গ্রাহক থেকে এক শতাংশের নিচে আদায় করছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি আদায় করেছে মাত্র ০.৫%, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ০.১%, আইএফআইসি ব্যাংক ০.৪%, মিডল্যান্ড ব্যাংক ০.৯% মধুমতি ব্যাংক ০.৩% এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ০.৭%, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক (গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক) ০.৮%, ওয়ান ব্যাংক ০.৪%, পদ্মা ব্যাংক ০.৩%, প্রিমিয়ার ব্যাংক ০.৬%, সাউথইস্ট ব্যাংক ০.৮% এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ০.৪%।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ের অবস্থা একই রকম। আলোচ্য সময়ে খেলাপিদের থেকে মাত্র ৩ লাখ টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংক আল-ফালাহ, ব্যাংকটির আদায়ের হার ০.১%। এ ছাড়া হাবিব ব্যাংকের আদায়ের হার ০.৩%।
প্রসঙ্গত, ব্যাংক খাতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৯৯ হাজার ১৬৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা (অভ্যন্তরীণ+অফশোর ইউনিট)। যা মোট ঋণ বিতরণের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত মার্চে খেলাপি ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র তিন মাসে ৩ হাজার ৭৯ কোটি এবং ছয় মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন