ইভ্যালিকাণ্ডের পরও ক্ষান্ত হয়নি বিতর্কিত ৯টি কম্পানি। নানা কৌশলে ডিজিটাল কমার্স নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা গ্রাহক ঠকিয়ে চলেছে। নজরদারির বাইরে থাকায় ফেসবুক পেজভিত্তিক এফ-কমার্স খাতের প্রতারণা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। অভিনব কায়দায় কোনো খরচ ছাড়াই শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুক) একটি পেজ আর কিছু পণ্যের ছবি দিয়েই প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি চক্র। সম্প্রতি এমন অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ই-ক্যাবের কাছে। সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতে ভুঁইফোড় ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের প্রতারণার কারণে ভালো কম্পানিগুলোও ইমেজ সংকটে পড়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেলকে সস্ত্রীক গ্রেপ্তারের পর আরো ৯টি প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে রেখেছে সরকার। এগুলো হচ্ছে আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদীনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডি।
ইভ্যালি, আলেশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্স কম্পানির সঙ্গে গত জুন মাসেই লেনদেন স্থগিত রাখার কথা জানিয়েছিল দেশের চারটি বেসরকারি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের প্রতি ওই সব ই-কমার্স কম্পানি থেকে পণ্য কিনতে তাদের ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছে। লেনদেন যদি করা হয় তবে তার দায়ভার তারা নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এ ছাড়া ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চারটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ স্থগিত করেছে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইভ্যালিসহ যে ১০টি কম্পানি সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাংক সতর্কতা জারি করে কার্ডে লেনদেন স্থগিত রেখেছিল, এখনো তাদের কেউ কেউ প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি। গত কয়েক মাসে আরো কিছু নতুন কম্পানিও গড়ে উঠেছে।’ তিনি বলেন, এসব কম্পানির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে ই-কমার্স খাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। গ্রাহকদেরও অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাঁরা বড় ডিসকাউন্ট ছাড়া পণ্যের অর্ডার করতে চান না। যাঁরা পণ্যও পাননি, টাকাও ফেরত পাননি তাঁদের ই-কমার্স সম্পর্কে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এতে সবারই ব্যাবসায়িক প্রবৃদ্ধি কমেছে।
ই-ক্যাব সূত্র জানায়, ক্রেতাদের পণ্য বা মূল্য ফেরত না দেওয়া, ই-ক্যাবকে নতুন মালিকদের পূর্ণ তথ্য না দেওয়ায় ই-অরেঞ্জের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে। অর্থ আত্মসাৎ, ইক্যাবের চিঠির জবাব না দেওয়া, অফিস বন্ধ পাওয়ায় টোয়েন্টিফোর টিকেটির সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া আর গ্রীণবাংলা ই-কমার্স ও এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাগ্রো ফুড অ্যান্ড কনজ্যুমার লিমিটেডের বিরুদ্ধে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ পাওয়ায় তাদের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া ৯টি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে ই-ক্যাব। এগুলো হচ্ছে ইভ্যালি ডট কম লিমিটেড : ফাল্গুনি শপ ডট কম, আলেশা মার্ট, ধামাকা শপিং, আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, আমার বাজার লিমিটেড, গ্লিটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ড ও অ্যানেক্স ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লিমিটেড।
এদিকে আইডি খোলার নাম করে ‘রিং আইডি’ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বেশি মুনাফার আশায় এখানে বিনিয়োগ করছেন গ্রাহকরা। কয়েকজন গ্রাহক জানান, ‘গোল্ড মেম্বারশিপ’ কেনার জন্য এক মাস আগে ২২ হাজার টাকা করে পেমেন্ট করেন তাঁরা। অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু তাঁদের আইডি এখনো অ্যাকটিভ হয়নি। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে জায়গায় যোগাযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি। এভাবে মেম্বারশিপের নামে শত শত গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রিং আইডি।
সূত্র জানায়, ‘ফাল্গুনি শপ ডট কম’-এর বিরুদ্ধে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের টাকা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া চালু করায় আলেশা মার্টের কাছে কার্ডের লিগ্যাল ডকুমেন্ট চেয়েছে ই-ক্যাব। অন্যদিকে ইভ্যালির মতো গ্রাহক ও মার্চেন্টদের টাকা দিচ্ছে না ‘ধামাকা শপিং’ (ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম লিমিটেড)। ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা পালন করছে না ‘আদিয়ান মার্ট’। তারাও গ্রাহক ও মার্চেন্টদের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।
‘সিরাজগঞ্জ শপ’ গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার নাম করে তা নিজেদের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করছে বলে নতুন অভিযোগ এসেছে। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের টাকা না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া আমার বাজার লিমিটেড, গ্লিটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ড ও অ্যানেক্স ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লিমিটেড—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে এমএলএমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এমএলএম ব্যবসা থেকে বের হয়ে নিয়মিত ই-কমার্স করার জন্য ই-ক্যাবের কাছে তিন মাস সময় চেয়েছে এবং এই তিন মাস সব ধরনের ব্যবসা বন্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের পাশাপাশি ই-ক্যাবেরও পর্যবেক্ষণে আছে বলে জানা গেছে।
বিতর্কিত এসব ই-কমার্স কম্পানির ব্যাবসায়িক মডেল প্রচলিত ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বছরখানেক আগেই সরকারকে তাদের সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে জানিয়েছিলাম। ইভ্যালিসহ আমাদের যেসব সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, আমরা তাদের প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। কিছু প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করে অ্যানালগ পদ্ধতিতে প্রতারণা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি। ই-কমার্স খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলায় আমাদের নজরদারি সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত লোকবল, শক্তিশালী মনিটরিং সিস্টেম নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে ডিজিটাল কমার্স সেল গঠন করা হয়েছে, সেখানে আলাদা করে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা অনেক মন্ত্রণালয় ই-কমার্স নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই।
ই-ক্যাবের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম শোভন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন নতুন উদ্ভাবনী ব্যবসার এবং প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পদ্ধতি ও পলিসি উন্নয়ন না করলে বারবার এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। আজ এদের বন্ধ করা না হলে কাল অন্য কেউ অন্য কোনোভাবে সুযোগটা নেবে।’ তিনি বলেন, ‘ই-ক্যাব থেকে রিস্ক ফ্যাক্টর মানেজমেন্ট কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। কারণ কেউ অন্যায় করলে তার জন্য প্রচলিত আইন রয়েছে। কিন্তু অন্যায়গুলো ঠেকানোর জন্য, মনিটর করার জন্য টুলস বা অথরিটি প্রয়োজন। বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ে এই কমিটি কাজ করবে। আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে কোন প্রতিষ্ঠান ভোক্তার কাছ থেকে কত টাকা নিচ্ছে। এ জন্য ফেয়ার ট্রেড কমিশন গঠন করার কথাও বলেছি। বিশ্বের অনেক দেশে এই কমিশন সঠিক ব্যবসা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে কাজ করে।’
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ৯টি কম্পানির অপারেশন ও আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য চেয়েছি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘ই-অরেঞ্জ এবং ইভ্যালির বিরুদ্ধে যেহেতু মামলা হয়েছে, তাই আমরা আদালতের আদেশের অপেক্ষায় আছি। এ ছাড়া আমরা ধামাকার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া অন্যান্য অভিযুক্ত ই-কমার্স কম্পানিগুলোকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’
সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে কত টাকার ব্যবসা করছে, কত টাকা লেনদেন করছে, তাদের মূলধনের পরিমাণ কত, এদের ব্যাবসায়িক ধরন সম্পর্কে জানতে মাঠে কাজ করছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ব্যাংকগুলোর কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত বিবরণ চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন