অতিরিক্ত দিনে নামমাত্র সমঝোতার মধ্যে শেষ হলো গ্লাসগো সম্মেলন। যাতে প্রায় ২০০টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই কম নয় । আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কাজ করা কর্মীরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কপ-২৬ এর প্রেসিডেন্ট অলোক শর্মা, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও খুশী হননি। এই ঠুনকো বিজয়ে।
নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর শনিবার রাতে চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়। অংশগ্রহণকারী ধনী দেশগুলো মতৈক্যে পৌঁছালেও অনেক দেশের মধ্যেই গভীর অসন্তোষ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্হ দেশগুলোর প্রয়োজনের তুলনায় কম ক্ষতিপুরণের বিষয়টি মানতে পারছেনা কেউই।
চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ ২৬) সভাপতি অলোক শর্মা একটি ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ ঘোষণা প্রকাশ করেছিলেন। এটি ছিল ঘোষণার তৃতীয় খসড়া, যা আগের দুটি খসড়ার মতোই ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে পারেনি, বরং পরিবেশবাদীদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছিল।
শনিবার গ্লাসগোতে প্রায় ২০০টি দেশের কূটনীতিকরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলিকে সহায়তা করার জন্য আরও পদক্ষেপের ব্যাপারে মতৈক্য পৌঁছান। কিন্তু শেষ মুহুর্তে চুক্তি সম্পন্ন হলেও জলবায়ু সংকট ঘিরে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
চুক্তিতে বিশ্বেনেতাদের কার্বন নির্গমন রোধে শক্তিশালী পরিকল্পনা নিয়ে আগামী বছর ফিরে আসতে বলার পাশাপাশি ২০২৫ সালের মধ্যে ধনী দেশগুলোকে অন্তত দ্বিগুণ তহবিল দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া রোধের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো রক্ষা পাবে।
তবে জলবায়ু সম্মেলনে জড়ো হওয়া হাজারো রাজনীতিবিদ ও পরিবেশ কর্মীদের জরুরি দাবি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা সমস্যা সমাধান করা যায়নি। এতে পরবর্তী দশকে প্রতিটি প্রতিটি জাতিকে কতটা এবং কত দ্রুত নির্গমন কমাতে হবে সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি অমীমাংসিত রেখে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও এতে অনেক উন্নয়নশীল দেশের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি তৈরি এবং ক্রমবর্ধমান চরম আবহাওয়ার বিপর্যয় মোকাবিলায় করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের ঘাটতি রয়ে গেছে।
বলা হচ্ছে, অসন্তোষ থাকলেও চুক্তিটি একটি সুস্পষ্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে সব দেশকে অবিলম্বে, বৈশ্বিক তাপমাত্রার বিপর্যয়কর বৃদ্ধি রোধ করতে আরও অনেক কিছু করতে হবে। চুক্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে আনা থেকে শুরু করে আরেকটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস, মিথেন নির্গমন রোধ করার জন্য বিশ্বের যে নির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত তার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে৷ এ ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছাতে অগ্রগতি বা ব্যর্থতার জন্য নির্দিষ্ট দেশকে দায়বদ্ধতা দেখাতে নতুন নিয়ম ঠিক করা হয়েছে।
চূড়ান্ত চুক্তিতে কয়লার ব্যবহার কমানো বা ‘ফেজ ডাউন’ করার ভাষাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে সেখানে বন্ধ করা বা ‘ফেজ আউট’ করার কথা ছিল। ভারতের পক্ষ থেকে এ পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মেক্সিকো এবং অন্যান্য দেশের আলোচকদের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধি সিমোনেটা সোমারুগা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ে ভাষা পরিবর্তনের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের ফেজ ডাউন প্রয়োজন নয়, আমাদের প্রয়োজন ফেজ আউট করা।
সুইজারল্যান্ডের এই প্রতিনিধি অভিযোগ করেন, শেষ মুহুর্তে কয়লার বিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকে কোন মতামত ছাড়াই পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ পরিবর্তন বিষয়ে আর মতামতের সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমরা প্রক্রিয়া এবং শেষ মুহূর্তের পরিবর্তন উভয় বিষয়েই হতাশ। এতে আমরা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রাখতে পারব না বরং লক্ষ্যে এটি লক্ষ্যে পৌঁছানো আরও কঠিন করে তুলবে।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা গেলে তা মানবজাতিকে জলবায়ুর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে সাহায্য করবে।
বিশ্ব নেতারা ২০১৫ সালে ব্যাপক নির্গমন হ্রাসের মাধ্যমে ১.৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বিশ্বকে উষ্ণতা বৃদ্ধি থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সর্বশেষ পূর্বাভাস বলছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য এবং সম্মেলনের প্রধান সংগঠক অলোক শর্মা এই প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। চুক্তি নিয়ে শনিবার রাতে এবারের সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট অলোক শর্মা এক সংবাদ সম্মেলনে একে ‘ঠুনকো বিজয়’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
অলোক শর্মা বলেন, ‘কঠিন কাজ এখন শুরু হলো। আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার লক্ষ্য টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। তবে আমি এখনো বলছি যে ১.৫ ডিগ্রির যে নাড়ি আমরা পাচ্ছি তা দুর্বল। আমরা যদি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি তবেই এটি টিকবে। তিনি বলেন, ‘গ্লাসগোতে ইতিহাস তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এটিকে একটি ‘বড় পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।’
চুক্তিতে শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য আহ্বান জানায় ভারত ও চীন। তারা কয়লার ব্যবহার ‘ফেজ আউট’ করার পরিবর্তে ‘ফেজ ডাউন’ করতে বলে। শেষ পর্যন্ত তা অনুমোদন পেলেও অনেক দেশ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস বলছে, চুক্তিটিতে কেবল ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্য টিকিয়ে রাখা হলো।
সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গ ব’লেছেন, এবারের সম্মেলনে সফল্য হচ্ছে, ব্লা ব্লা ব্লা। তার কথার পরিষ্কার ফুটে উঠেছে, কপ-২৬ একটি বড় পিকনিক ছাড়া পৃথিবীর জন্য কার্যকর কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি।আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন