ভালো একটা চাকরি শিক্ষিত তরুণদের সবচেয়ে বড় চাওয়া। স্মার্টফোনের ডিজিটাল রঙিন দুনিয়াও সমানভাবে আকর্ষণ করে তাদের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনুন্নত দেশ আফগানিস্তানের পরিস্থিতিও এর বিপরীত নয়। আর এগুলোকেই মোক্ষম সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করেছে তালেবান। চাকরি আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাজার হাজার গরিব আফগান তরুণ-যুবাদের দলে ভিড়িয়েছে গোষ্ঠীটি। কাবুলের ক্ষমতা দখলের পরও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে অনলাইনে ব্যাপক উপস্থিতি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে বলে স্বীকারও করেছেন এর নেতারা।
আগের (১৯৯৬-২০০১) শাসনামলে শরিয়াহ আইন জারির মাধ্যমে টেলিভিশন দেখা, গান শোনা ও নারী শিক্ষার মতো কার্যক্রমের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তালেবান। ছবি দেখা যায় এমন সব প্রযুক্তি-যন্ত্র কারও কাছে পেলে তাকে শাস্তি দিত তারা। তবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আস্তে আস্তে তথ্য ও প্রযুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তালেবান। এরপর ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তিগুলোকে কাজে লাগাতে শুরু করে।
নিক্কেই এশিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই গোষ্ঠী ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের মতো প্রযুক্তি গ্রহণ করে অন্তত কিছু উপায়ে নিজেদের আধুনিক যুগের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। এর সদস্যদের হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। সম্প্রতি মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর একের পর এক আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহর দখল করে এর যোদ্ধারা। তবে শহর দখলই নয়, এ সময় স্মার্টফোনের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে নিজেদের সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা প্রচার করে তারা। আমেরিকা সমর্থিত সরকার নয়, তালেবানই আফগানিস্তানের উপযুক্ত শাসক-এ বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
সম্প্রতি রাজধানী কাবুলে ২০ বছর বয়সি এক তালেবান যোদ্ধার সাক্ষাৎকারে সেসব তথ্যই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ভোর ৫টায় উঠে একসঙ্গে নামাজ পড়ি ও কুরআন তেলওয়াত করি। এরপর সকালের খাবার খেয়ে ৭টায় কাজ শুরু করি। আমরা স্মার্টফোনও ব্যবহার করি।’ কাবুলে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করা ওই তালেবান যোদ্ধা জানান, সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বাড়ি ফেরার পর তিনি তার ফোনে খবর দেখেন। কলও করেন। কিন্তু কোনো সিনেমা কিংবা বিনোদনমূলক কিছু দেখেন না।
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তালেবান গোষ্ঠীতে ৮০ হাজার পুরুষ যোদ্ধা আছে বলে মনে করা হয়। শেষবার ক্ষমতায় থাকাকালীন অবকাঠামোগত অভাবের কারণে এই গোষ্ঠীর হাতে ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। এখন এই গোষ্ঠী তাদের সদস্যদের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেয় এবং তারা টুইটারের মতো প্ল্যাটফরমে বিভিন্ন কনটেন্ট পোস্ট করেন। দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার পর গত ১৭ আগস্ট একজন তালেবান মুখপাত্র যখন প্রেসের সামনে আসেন, তখন তার সমর্থকদের অনেককে স্মার্টফোনে সেলফি তুলতে দেখা যায়। তালেবান নেতারা এটা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, অনলাইন ছাড়া তারা ‘ইন্টারনেট প্রজন্মের’ মন রক্ষা করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে তারা প্রতিযোগিতায় হেরেও যেতে পারেন। যদিও বিশ্বাস করা হয়- গান, চলচ্চিত্রসহ ইন্টারনেটনির্ভর অন্যান্য বিনোদন নিষিদ্ধই থাকবে। আর অনেক তরুণ তালেবান যোদ্ধার চূড়ান্ত আবেদন হলো চাকরির প্রতিশ্রুতি। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন অবস্থানের সময় আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বন্যা বয়ে গেলেও সেখানকার অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। ২০১৯ সালে করা এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক জরিপে, ৭০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা চাকরির সুযোগের অভাবকে যুব সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। তালেবান গোষ্ঠী মনে করে, মাদক ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা ব্যবহার করে দরিদ্র যুবকদের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরির সম্ভাবনা কম। কাবুলে পরবর্তী মিশনের জন্য অপেক্ষারত ২০ বছরের কিছু বেশি বয়সি এক তালেবান যোদ্ধা বলেন, ‘আমি মাসে ১০ হাজার আফগানি (১১৮ ডলার) আয় করি। যা সত্যিই যথেষ্ট নয়।’
পঞ্জশির এখনো দখলে না এলেও শনিবার রাতে ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফোর্সের (এনআরএফ) প্রায় ৭০০ যোদ্ধা নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে তালেবান। ওই রাতেই ‘হত্যার আনন্দে’ এলোপাতাড়ি গুলি চালানোয় ১৭ জন সাধারণ আফগানের মৃত্যু হয়। খাবার, ওষুধ সরজ্ঞাম, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু থেকেই পঞ্জশির বিচ্ছিন্ন। স্পষ্টতই চাপে আফগানিস্তানের একমাত্র ‘স্বাধীন’ প্রদেশ। আশরাফ ঘানি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমারুল্লাহ সালেহ। যিনি নিজেকে এখন দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দাবি করেন, শনিবার তিনি জাতিসংঘে চিঠি লিখে পঞ্জশিরের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘মনুষ্যত্বের বিপর্যয়’ বলে ব্যাখ্যা করেন। এখনই যদি আন্তর্জাতিক দুনিয়া এই বিষয়ে নজর না দেয় তা হলে মানবতার জন্য আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। জাতিসংঘে চিঠি লিখে সালেহ জানিয়েছেন, প্রায় ২.৫ লাখ মানুষ যাদের মধ্যে স্থানীয় নারী, শিশু এবং প্রবীণরা আছেন এবং কাবুল ও অন্যান্য শহর থেকে ছিন্নমূল প্রায় ১০ হাজার মানুষ এখন পঞ্জশির উপত্যকায় আটকে আছেন। এদিকে উপত্যকায় খাদ্য এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক দ্রব্য আসার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান। এখনই যদি এই পরিস্থিতির প্রতি নজর না দেওয়া হয় তবে শিগগিরই পুরোমাত্রায় মানবাধিকার এবং মনুষ্যত্বের বিপর্যয় দেখা দেবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন