আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার কারণে মিয়ানমার বিচারহীনতার মনোভাব নিয়ে রোহিঙ্গাসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংসতা চালিয়ে যেতে পারছে বলে অভিযোগ করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সুরাহার প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কখনোই প্রদর্শন করেনি। প্রকারান্তরে তারা নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে, ভিত্তিহীন দাবি করে এবং বাংলাদেশের ওপর অন্যায়্যভাবে দায় চাপিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করেছে এবং নিজেদের দায় এড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের সাথে সই হওয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফেরত নেয়নি।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শাহরিয়ার আলম এ সব কথা বলেন। ওয়েবিনারে প্যানেলিস্ট হিসেবে বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সিনিয়র ফেলো ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার) দেলোয়ার হোসেন এবং বিআইআইএসএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইআইএসএসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইমদাদুল বারী।
ভাসানচর নিয়ে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচর স্থানান্তর ইস্যুর সমাধান হয়ে গেছে। এটা এখন আর কোনো ইস্যু নয়। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করেছেন। সরকারের সাথে মতভেদ হওয়ার মতো কোনো বিষয় তারা পাননি। তবে জাতিসঙ্ঘের কিছু ছোটখাটো সুপারিশ রয়েছে। আমরা আশা করছি, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মতোই জাতিসঙ্ঘসহ মানবিক সংস্থাগুলো ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেয়ার জন্য এগিয়ে আসবে।
শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা অনেক বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি সন্তুষ্ট, আবার অনেক বন্ধুরাষ্ট্রের অবদান ও অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। অনেকেই প্রত্যাবাসনে ভূমিকা না রেখে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কিভাবে রেখে দেয়া যায়, সেই চেষ্টা করছে। এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যতটুকু করার ছিল, তারা এখনো তা করেনি। তবে এ বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি।
মিয়ানমার একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারত সীমান্তের দিকে মিয়ানমারের উদ্বাস্তুরা আসছে। রাখাইনে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর জোরাল অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত এখনো শান্ত রয়েছে। তিনি বলেন, নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রোহিঙ্গাদের আরো সক্রিয় হতে হবে। রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর যাতে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের কানে পৌঁছায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইন্দোনেশিয়ায় আগামী শনিবার অনুষ্ঠেয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ উল্লেখ করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই সম্মেলনে সু চি সরকারের পতনের পর মিয়ানমার পরিস্থিতি প্রাধান্য পেতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত এনএলডিসহ মিয়ানমারের আন্দোলনকারী দলগুলোর জোট জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের (এনইউজি) কোনো প্রতিনিধি এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং শীর্ষ সম্মেলনে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করবেন। এ সম্মেলনে দক্ষিণ চীন সাগরসহ আসিয়ান দেশগুলোর জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ানো ইস্যুগুলোই সামনে চলে আসবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে মিয়ানমারের সাথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে বিকল্প খুব একটা কিছু নেই।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মিয়ানমারে চীন ও ভারতের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে মিয়ানমারের সহায়তা প্রয়োজন। আবার চীনের সীমান্তে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণেও মিয়ানমারকে দরকার। দুই দেশকেই তাদের ভূমিবেষ্টিত রাজ্যগুলোর জন্য সমুদ্রপথে আমদানি-রফতানিতে মিয়ানমারের বন্দর ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া সমরাস্ত্র বিক্রি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধাতো রয়েছেই। মিয়ানমারের মনপুত হয় নাÑ এমন কোনো কাজ ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে চীন বা ভারত কেউই করবে না। তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘে চীন সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষে এবং ভারত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে। তবে ভারতের নাগরিক সমাজকে মিয়ানমারের গণহত্যার বিচার চাওয়ার জন্য সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। রোহিঙ্গা সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, এই সঙ্কটটি এখন একটি টাইমবোমায় পরিণত হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন