ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়কের ভূমিকায় দায়িত্বপালনকারী গুম-খুনের দায়ে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পুলিশের বিদায়ী আই জি বেনজির আহমদ শেখ হাসিনর সরকারের ভূয়সি প্রশংসা করেছেন। তবে তিনি বিরোধী দলের প্রতি ইঙ্গিত করে দেশের রাজনীতি নিয়ে তীর্যক মন্তব্যও করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে একধরনের নষ্ট রাজনীতির দুষ্টচর্চায় লিপ্ত ছিল, এখনো আছে। আরো বলেছেন, একশ্রেণীর মানুষের নষ্ট রাজনীতির দুষ্টচর্চায় যারা আমাকে অন্যায় ও আযৌক্তিকভাবে তাদের বিপক্ষে আবিষ্কার করেছে তাদের প্রতিও আজ আমার কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ নেই।
বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক (ডিজি) ও পুলিশের নতুন আই জি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম ও অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) কামরুল আহসান প্রমুখ।
শেখ হাসিনার অপরাজনীতির সহায়ক রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত এই পুলিশ কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার আগের দিন নিজের অপকর্মের জন্য রাজনীতিবিদদের কাঁধে দোষ চাপিয়ে বলেন, তারাও ভালো থাকবেন, সে প্রত্যাশা করবো।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত বেনজীর বলেন, সবাই মিলেই বাংলাদেশ। সবাই মিলেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে যে যেখানে আছি সেখান থেকে দায়িত্ব পালন করবো।
শেখ হাসিনার চাটুকারিতা করে তিনি বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে আজকে বাংলাদেশ এ পর্যায়ে এসেছে। ১৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে ৪৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভে এসে পৌঁছেছে দেশে। প্রায় তিন হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ে পৌঁছেছে। এসময়ে নানা দারিদ্র, অসুখ-বিসুখ, বঞ্চনা দেখেছে দেশ। অনেক ধরনের রাজনীতির খেলা হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার অনুগত ও বিশ্বস্ততার সাথে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক, গুম-খুন অব্যাহত রাখা বেনজীর আহমেদের মতো ভয়ঙ্কর খুনী, নৈতিক স্খলনে দুষ্ট কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও আইজি হয়নি বলেই মনে করেন পুলিশ বিভাগের অনেক কর্মকর্তা। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরই তাকে বানানো হয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার। অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে পুলিশকে ব্যবহার করেছেন বেনজীর আহমদ। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে রাতের আধারে গণহত্যা বেনজীর আহমদের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল। এই গণহত্যায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেনজীর তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু গণহত্যাই নয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের নামে তামাশার আয়োজনের আগে গড়ে উঠা আন্দোলন দমনের নামে চালানো কথিত ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনা গুলোরও মূল নায়ক ছিলেন এই বেনজীর আহমদ। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম সহযোগী হিসাবেই ২০১৫ সালের এপ্রিলে বেনজীর আহমদকে র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেন শেখ হাসিনা।
২০২০ সালের ১৫ই এপ্রিল পুলিশ মহাপরিদর্শক হবার পর চলতি বছরের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পদে আসীন থেকে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার অপরাজনীতির নীলনকশা বাস্তবায়নে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন নি।
২০১৩ সালের ৫ই মে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের দোসর পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি (সাবেক বিডিআর) যৌথভাবে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে। মধ্যরাতের অন্ধকারে বিদ্যুৎ বন্ধ করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল সেদিন। এই গণহত্যায় যৌথবাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনীও যোগ দিয়েছিল অস্ত্র হাতে। এই গণহত্যার দিনটি ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের এক বিশেষ মাইল ফলক হিসাবেও চিহ্নিত হয়ে আছে ইতিহাসে।
গণহারে আলেম হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তখনকার ঢাকা মহাগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ।
৫ই মে’র গণহত্যায় কত মানুষ নিহত হয়েছিলেন তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনো নেই। তবে ইতিহাস একদিন সেই রাতে শাহাদাতবরণকারী আলেম, মাদ্রাসা ছাত্র ও সাধারণ নাগরিকদের নামের তালিকা অবশ্যই খুঁজে বের করবে। এই গণহত্যার বিচারও একদিন হয়ত হবে দেশের মাটিতেই।
ওই রাতের নৃশংস হামলায় যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন তাদেরকেও পরবর্তীতে নির্যাতনর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এছাড়া শাপলা চত্বর থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন মহাসচিব ও পরবর্তীতে আমীরের দায়িত্বপালনকারী মরহুম আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর মত আলেমকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছিল বেনজীর আহমদের নির্দেশেই। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর সুস্থ হতে পারেননি।
হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আহতদের অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বেনজীর আহমেদের নির্দেশে বিভিন্ন থানার পুলিশ ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালিয়েছিল। আহত অবস্থায় তাদেরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডেও নেওয়া হয়।
শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ছাড়াও ঢাকায় তখন অনেক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে গুম এবং ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়। এই গুম-খুনের পুরস্কার হিসাবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার তাকে র্যাবের মহাপরিচালক ও পরবর্তীতে পুলিশের আইজি হিসাবে পদোন্নতি দেয়।
পুলিশ ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত এবং টিকিয়ে রাখতে নিরন্তর অপচেষ্টায় ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মূলত: কাজ করেছেন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন রাজনৈতিক কর্মীর মত। বিরোধী দলকে দমনে সিদ্ধহস্ত এই পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে অসংখ্য বিরোধী দলীয় কর্মীকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম করা হয়েছে। ভিকটিমদের পরিবার গুলো একদিন ন্যায় বিচারের জন্য আবেদন জানানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন