রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১৮ সালে পূর্বাচল প্রকল্পের ৭৬ দশমিক ৮৩ কাঠার জমি পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে প্রাথমিক বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে একই প্লট রাজউকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জালিয়াতি করে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে চূড়ান্ত বরাদ্দ দেয়।
এ ঘটনা জানাজানির পর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য রাজউকের সদস্যকে (এস্টেট ও ভূমি) প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে রাজউক কর্তৃপক্ষ। কমিটি তদন্ত শেষ করে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
এদিকে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের প্লট পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দ দেওয়াসহ পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। শিগগিরই অভিযোগ অনুসন্ধান করতে টিম গঠন করবে কমিশন।
এ বিষয়ে দুদকের পরিচালক (দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল) উত্তম কুমার ম-ল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে- রাজউকের এস্টেট শাখার কয়েকজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে সৈয়দা ফেরদৌসী আলম নীলার কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দকৃত প্লট নিয়মবহির্ভূত ও অবৈধভাবে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন নাম দেওয়া হয়েছে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেড। একই সঙ্গে কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দসহ উচ্ছেদ অভিযানের নামে ঘুষগ্রহণ, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগটি ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে দাখিল করা হয়েছিল। অভিযোগটি রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান ও অন্যদের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগের সঙ্গে অনুসন্ধানের জন্য কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
দুদকের তথ্যমতে, আলোচিত ঠিকাদার জিকে শামীমসহ বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান ২০১৯ সাল থেকে চলমান রয়েছে। ওই অভিযোগে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জন করে বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের কথা বলা হয়েছিল। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম ওই অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছে। ওই অভিযোগের সঙ্গে এ অভিযোগ অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৭ মে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। আবেদনের শেষ তারিখ ছিল একই বছরের ২৩ নভেম্বর। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেড ছাড়পত্রের জন্য জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে আবেদন করে এবং নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয় ৭ অক্টোবর। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজারুল হক শহিদ। আর পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের ছাড়পত্রের জন্য ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর আবেদন করে এবং নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয় ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান সৈয়দা ফেরদৌসি আলম নীলা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহ আলম ফটিক ও পরিচালক মিস শাহরিয়া আলম।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন জমা পড়ে। আবেদনের সঙ্গে শর্ত অনুযায়ী ১৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমার রশিদ দেওয়া হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজউকের ১৩তম বোর্ডসভায় পূর্বাচল কনভেশন লিমিটেডকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর পর একই বছরের ৩ অক্টোবর পূর্বাচল কনভেশন লিমিটেডের নামে পূর্বাচল প্রকল্পের ১ নম্বর সেক্টরের ২০৪ নম্বর সড়কের ৭৬ দশমিক ৮৩ কাঠা আয়তনের ৩ নম্বর প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দকৃত প্লটটি পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য রাজউকে আবেদন করা হয়। আবেদনের পর দিন নাম পরিবর্তন বিষয়ে নথিতে উপস্থাপন করা হলে রাজউক চেয়ারম্যান প্রস্তাব অনুমোদিত লিখে স্বাক্ষর করে দেন। এর পর ২০ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের পরিবর্তে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত পত্র জারি করা হয়।
তথ্য বলছে, সাময়িক বরাদ্দপত্র ইস্যুর পর সৈয়দা ফেরদৌসি আলম নীলা ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্লটের প্রথম কিস্তির তিন কোটি এক লাখ ৩২ হাজার জমা দেন। পরে ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই দ্বিতীয় কিস্তির দুই কোটি ২৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর তৃতীয় কিস্তির দুই কোটি ৫৩ লাখ ১০ হাজার ৮৮০ টাকা জনতা ব্যাংকে জমা দেন।
অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা পরিবর্তন করতে হলে যিনি প্রদান করবেন এবং যাকে প্রদান করবেন তাদের উভয়কে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিসহ রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিকট হাজির হতে হয়। অথচ রাজউকের পূর্বাচল শাখার কর্মকর্তারা এক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দকৃত প্লটটি আরেক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়ার আগে এ বিষয়ে কোনো শুনানি করেনি। এমনকি প্লটটি পরিবর্তনে যে ফি জমা দিতে হয়, সেটিও জমা হয়নি। ঘুষের বিনিময়ে রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের কর্মকর্তাসহ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী এক প্রতিষ্ঠানের প্লট আরেক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেয়।
বিষয়টি জানার পর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া রাজউকে আবেদন করেন। কিন্তু রাজউক বিষয়টি সমাধান না দিয়ে তালবাহানা করতে থাকেন। উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট ঘটনাটি তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে আদেশ জারি করেন। এর পর রাজউকের সদস্যকে (এস্টেট ও ভূমি) প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তদন্ত শেষ করে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে প্রতীয়মান হয়েছে কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া ও সৈয়দা ফেরদৌসি আলম নীলার দাবিকৃত পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেড একই প্রতিষ্ঠান। পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নাম পরিবর্তন করে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন