জনপ্রশাসনে সরকারের বিভিন্ন পদগুলোতে পদোন্নতি ও লোভনীয় পদগুলোতে পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠছে। বিগত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত এ ঘটনায় এখন তদবিরেই ভরসা রাখছেন সরকারের কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের পদোন্নতি এবং পদায়নে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরাও বিধি লঙ্ঘন করে তাদের পক্ষে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও সচিবের কাছে আধাসরকারি পত্র দিচ্ছেন।
কর্মচারীদের পক্ষে তদবির আইনত নিষিদ্ধ হলেও মানছেন না তারা। আর এসব তদবিরের আধাসরকারি পত্রগুলো উপস্থাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীরা। এভাবে নিয়ম না মেনে তদবিরের ওপর চলছে পুরো প্রশাসন।
সরকারি টাকায় দুই দেশে শিক্ষাসফর শেষে ফিরে পরদিনই অবসরে গেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিডি) সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। অবসরের আগ মুহূর্তে তার এই শিক্ষাসফর সরকারের কী কাজে আসবে, তা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এরপর সেই সচিবকে দুই বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো: তাজুল ইসলাম।
আধাসরকারি পত্রে তার পরিচয় উল্লেখ করে মন্ত্রী লিখেছেন, তিনি সরকারি চাকরির পূর্ণ সময়ে মাঠপ্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে অনেক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের সচিব এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে সিনিয়র সচিব হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাই আমি মনে করি এ রকম কর্মকর্তার সেবা আরো বেশিদিন যদি দেশ পায় তাহলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতো। অন্য দিকে তিনিও যেহেতু আরো বেশিদিন কাজ করার আগ্রহী, তাই তাকে আরো দুই বছর সরকারের প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার জন্য সুপারিশ করছি।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো: জাকির হোসেন। দুই বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন তিনি।
আধাসরকারি পত্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক মো: আতাউর রহমানের পরিচয় উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতে যোগদানের পর থেকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুনামের সাথে পালন করে আসছেন। আগামী ২৯ জুলাই তিনি পিআরএলএ যাবেন। প্রতিষ্ঠানটির চলমান কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখার স্বার্থে তার চাকরিকাল বর্ধিত করা আবশ্যক।
এমতাবস্থায় তার চাকরি আগামী দুই বছরের জন্য বর্ধিত করার বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত সহযোগিতা কামনা করছি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকে সচিব/গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে দেয়া আধাসরকারি পত্রে তিনি লিখেছেন, হাবিবুর রহমান রেলপথ মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর থেকেই রেলপথকে জনবান্ধব, সাশ্রয়ী, আরামদায়ক, নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্য রেলপথ খাতের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছেন। তিনি নিয়মিতভাবে যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন কিন্তু অদ্যাবধি সচিব/গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি পাননি। আগামী ১৫ জুন তিনি অবসর-উত্তর ছুটিতে গমন করবেন। এর পূর্বে হলেও তার সচিব/গ্রেড-১ পদে পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য। এমতাবস্থায় তাকে পদোন্নতির জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেন রেলমন্ত্রী।
ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) পদটি লোভনীয়। এই পদে পদায়নের জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন ফায়ার সার্ভিসের ১১ মডার্ন প্রকল্পের পরিচালক শহীদ আতাহার হোসেনের জন্য আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন জামালপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য মির্জা আজম।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে লেখা আধাসরকারি পত্রে তিনি লিখেছেন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) পদটি শূন্য হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত থাকায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মো: শহীদ আতাহার হোসেনকে ওই পদে পদায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোর সুপারিশ করছি। উল্লেখ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একজন নিবেদিত কর্মকর্তা।
১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী তাঁর চাকরি-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন না। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোনো সরকারি কর্মচারীর ওপর রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব খাটাইতে বা খাটাইবার চেষ্টা করিতে পারিবেন না।’
একই আইনে তদবির করার জন্য সংসদ সদস্যদের কাছে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আইনটির ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন সরকারি কর্মচারী কোনো ব্যাপারে তাহার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুরোধ জানাইতে পারিবেন না।’
১৯৫৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা এক স্মারকেও কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরিসংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের কাছে তদবির করতে পারবেন না বলে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারি কর্মচারীদের পক্ষে কোনো মন্ত্রী বা এমপি তদবির করতে পারেন না। সরকারি বিধিতে তদবির নিষিদ্ধ করা আছে। এরপরও যারা করেন, তারা গুরুতর অন্যায় করেন। আইন ও সুশাসন না থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন