‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’—ভাষার জন্য বাঙালির রক্তদানের স্মৃতি জড়ানো অমর এই গানের স্রষ্টা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর নেই। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় দুুপুর পৌনে ১২টার দিকে মৃত্যু হয় প্রখ্যাত এই লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্টের। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম এই তথ্য জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকবদলের সাক্ষী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী নানা ধরনের অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তাঁর মরদেহ লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকার বনানীতে স্ত্রী সেলিমা আফরোজের কবরের পাশে মরদেহ দাফন করা হবে বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রয়েছে তাঁর। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। সেখানে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে তাঁর কলম সোচ্চার ছিল বরাবর। প্রবাসে থেকেও কালের কণ্ঠসহ ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি যেমন রাজনৈতিক ধারাভাষ্য আর সমকালীন বিষয় নিয়ে একের পর এক নিবন্ধ লিখে গেছেন, তেমনি লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধ।
বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার সদস্যসহ বিশিষ্টজনরা।
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর মেধা-কর্ম ও লেখনীতে এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন। তিনি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের উলানিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী, মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তিনি চার মেয়ে ও এক ছেলের জনক; এর মধ্যে তৃতীয় মেয়ে বিনীতা এপ্রিলে মারা গেছেন।
উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে হাই স্কুলে ভর্তি হন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজ থেকে পাস করেন ইন্টারমিডিয়েট। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪৬ সালে গ্রাম ছেড়ে বরিশাল শহরে চলে এসেছিলেন গাফ্ফার চৌধুরীরা। তখন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। স্কুলে পড়ার সময় কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত কংগ্রেস হিতৈষী পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। পরে তিনি দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, মাসিক সওগাত, মাসিক নকীব, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক জয় বাংলাসহ বহু পত্রিকার সঙ্গে ছিলেন। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে ভীমরুল, তৃতীয় মত, কাছে দূরে, একুশ শতকের বটতলায়, কালের আয়নায়, দৃষ্টিকোণ শিরোনামে নিয়মিত কলাম লিখেছেন তিনি।
তরুণ বয়সে বহু কবিতা লেখা গাফ্ফার চৌধুরীর প্রথম বইটি ছিল শিশুদের জন্য। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ের নাম ছিল ‘ডানপিটে শওকত’। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কৃষ্ণপক্ষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’। ‘নাম না জানা ভোর’, ‘নীল যমুনা’, ‘শেষ রজনীর চাঁদ’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘সুন্দর হে সুন্দর’, ‘বাংলাদেশ কথা কয়’—তাঁর লেখা বইগুলোর অন্যতম। তাঁর লেখা নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’। তাঁর লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেসকো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মানিক মিয়া পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীরের শোক
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর। বাজুস প্রেসিডেন্ট শোকবার্তায় বলেন, “ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। ”
শোকবার্তায় দেশের শীর্ষ শিল্পোদ্যোক্তা সায়েম সোবহান আনভীর বলেন, “বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এবং আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখনী, বিশেষ করে তাঁর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গান এক অমর সৃষ্টি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর প্রকাশিত পত্রিকা ‘জয় বাংলা’ মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ”
বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন