লঞ্চের ইঞ্জিনে ব্যবহৃত এক ধরনের ছোট চাকাজাতীয় যন্ত্রাংশ, যা ফ্লাই হুইল কাপলিং ডিস্ক নামে পরিচিত; এর প্রতিটি কেনা হয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৫০০ টাকায়। অথচ এটির বাজারমূল্য ১৫ হাজার টাকা। ধুলাবালি পরিষ্কারের যন্ত্র কেনা হয়েছে ৬ লাখ ৮২ হাজার টাকায়। অথচ বাজারে ওই মানের যন্ত্রের দাম সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। ইঞ্জিনে ব্যবহৃত পিনিয়নের দাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা প্রতিটি, এটা কেনা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। প্লাস্টিকের ৪০০ টাকার একটি বালতি কেনা হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়, ১ হাজার ২০০ টাকার টেবিল ক্লথ কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৩০০ টাকায়। যে মানের মশারি কেনা হয়েছে ৩ হাজার ১০০ টাকায়, সেটার দাম বাজারে ৪০০ টাকা। এমন ১৩টি পণ্যের প্রকৃত মূল্য যাচাই করে দেখা গেছে এসব পণ্য কেনা হয়েছে গড়ে ১৫৯৭ শতাংশ বেশি দামে।
দেশে প্রচলিত এমন পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে প্রকৃত দাম থেকে ৩০০-৪০০ শতাংশ বেশি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অপ্রচলিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রায় ৭ হাজার শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দাম দিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের প্রকৃত দাম ১০ হাজার টাকা, কেনা হয়েছে ৬ লাখ ৮২ হাজার টাকায়। শতাংশের হিসাবে ৬৮২০ শতাংশ বেশি। বাড়তি দাম নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি নতুন কৌশল।
এমন অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটাগুলো করেছে সরকারের বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। সংস্থাটি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে জাহাজের খুচরা যন্ত্রাংশ ও বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণ ও সংস্কার কাছে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব কেনাকাটায় সংস্থাটি ব্যয় করেছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
ওই বছরের ডিসেম্বরে রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকার মো. মনির হোসেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ করেন। এর মধ্যে রয়েছে ওই ১ হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা। বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী আবদুল গফুর সরকারের নেতৃত্বে একটি চক্র এ কেনাকাটার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার অভিযোগ আমলে নিয়ে গত বছর ২৭ নভেম্বর দুদক এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে নৌপরিবহন সচিবকে ব্যবস্থা নিতে বলে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে মতামত দিতে বলে। তবে এখন পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান অভিযোগের বিষয়ে মতামত দেননি।
সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তুরস্ক সফরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটা : দেশের একটি আসবাব কোম্পানির কাছ থেকে চট্টগ্রামের বিআইডব্লিউটিসির একটি অতিথি কক্ষের জন্য ৩৪ লাখ টাকার কেনাকাটা করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, একটি অতিথি কক্ষের জন্য ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ টাকা। অথচ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৪ লাখ টাকা। ব্যয়ের তালিকায় থেকে জানা যায়, একটি সাধারণ স্পঞ্জের স্যান্ডেল কেনা হয়েছে ৬০০ টাকায়, অথচ বাজারে সেটার দাম ১৫০ টাকা। ৩ হাজার টাকার একটি দেয়ালঘড়ি কেনা হয়েছে ১৬ হাজার ৫০০ টাকায়। ৪০০ টাকার একটি বালতি কেনা হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। ১ হাজার ৫০০ টাকার একটি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯০০ টাকায়। ডাইনিং টেবিলের একেকটি চেয়ার কেনা হয়েছে ১৩ হাজার ৬২২ টাকায়, বাস্তবে এসব চেয়ারের প্রতিটির দাম ৭ হাজার টাকার বেশি নয়। ১২ হাজার টাকার পর্দা কেনা হয়েছে ৫৩ হাজার টাকায়।
ঢাকার সদরঘাটের সিমসন রোডের তৃপ্তি মেরিন মার্কেটে জাহাজের খুচরা যন্ত্রপাতি বিক্রি হয়। এ মার্কেটে দাম যাচাই করে বিআইডব্লিউটিসির কেনা দামের সঙ্গে বিস্তর ফারাক পাওয়া গেছে। দুদকে দেওয়া অভিযোগের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে।
মারিয়া এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আটটি রিং পিস্টন কেনা হয়। বিআইডব্লিউটিসি প্রতিটি রিং পিস্টন কিনেছে ৫ হাজার ২২৫ টাকায়। অথচ এর বাজারমূল্য ৪০০ টাকা। একই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিলিন্ডার লাইনার কেনা হয় আটটি, যার প্রতিটির দাম দেওয়া হয়েছে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা, বাস্তবে এর দাম ২ হাজার ৫০০ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একটি টার্বো চার্জার কেনা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকায়, এটির বাজারমূল্য ৫০ হাজার টাকা।
রায়হান এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আটটি সিলিন্ডার লাইনার কিনেছে বিআইডব্লিউটিসি। এ যন্ত্রের প্রতিটির দাম দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ টাকা করে, অথচ বাজারে এর দাম ৩ হাজার টাকা। এ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুটি পানির পাম্প কেনা হয়েছে। প্রতিটির দাম দেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার টাকা, অথচ বাজারে এ ধরনের পানির পাম্পের দাম ২০ হাজার টাকা। রায়হান এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে বিআইডব্লিউটিসি ভলভো ইঞ্জিনের দুটি টার্বো চার্জার কিনেছে, যার প্রতিটির দাম দিয়েছে ৫ লাখ ২ হাজার ২৫০ টাকা, অথচ বাজারে এর দাম ৫০ হাজার টাকা। একই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ডেট্রয়েট ব্র্যান্ডের বিএইচপি-৪৪০ মডেলের ডিজেল ইঞ্জিনের টার্বো চার্জার কেনা হয়েছে একটি, বিআইডব্লিউটিসি যার দাম দিয়েছে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অথচ বাজারে এ চার্জারের দাম ২৫ হাজার টাকা। রায়হান এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে গ্যাসকেট কেনা হয়েছে চারটি, যার প্রতিটির দাম দেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ৯০০ টাকা। অথচ বাজারে এরকম গ্যাসকেটের দাম ৬ হাজার ৫০০ টাকা।
এলআর এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বিআইডব্লিউটিসি ডেট্রয়েট ব্র্যান্ডের ইঞ্জিনের জন্য গিয়ার ফিল্টার কিনেছে ১২টি। প্রতিটির জন্য দাম দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ৯৫০ টাকা, বাস্তবে পুরান ঢাকার মেরিন মার্কেটে এ ফিল্টার বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ১ হাজার ৭০০ টাকা করে। এলআরের কাছ থেকে ৪২টি লুব অয়েল ফিল্টার ও ৪৩টি ডিজেল ফিল্টার কেনা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি লুব অয়েল ফিল্টারের দাম পরিশোধ করেছে প্রতিটির জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা, অথচ বাজারে দাম ৭০০ টাকা। ডিজেল ফিল্টারের দাম দিয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা, এটির প্রকৃত দাম ৫০০ টাকা।
অপ্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়ন : রাজধানী ঢাকায় বিআইডব্লিউটিসির গুলশান, বাংলা মোটর, নারায়ণগঞ্জ (দুটি), খুলনা ও চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগ করেছেন মনির হোসেন নামে ওই ব্যক্তি। তার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, পরিচালক (প্রশাসন) তাজুল ইসলাম ও ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী পছন্দের ঠিকাদারকে বাড়তি দামে কাজ দিয়েছেন। এসবের মধ্যে এমন কিছু কাজ ছিল, যা অপ্রয়োজনীয়।
এর মধ্যে বাংলা মোটরে বিআইডব্লিউটিসির প্রধান কার্যালয় ফেয়ারলি হাউজে আটটি টিনশেড ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এটির অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৭ কোটি টাকা, পরে এটি বেড়ে ১৩ কোটি টাকা হয়েছে।
সিন্ডিকেটের খপ্পরে বিআইডব্লিউটিসি : ২০১৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিসির প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার কেনাকাটার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির একটি সিন্ডিকেট কাজ করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ চক্রে আছেন বলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা হলেন বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী আবদুল গফুর সরকার, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী, মহাব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্বে) জেসমিন আরা বেগম, জিএম (মেরিন) শওকত সরদার, মুখ্য নৌ-নির্মাতা জিয়াউল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার শামছুদ্দিন, উপ-মুখ্য ক্রয় কর্মকর্তা কামরুন নাহার বীথি। এর মধ্যে আবদুল গফুর সরকার, মোহাম্মদ আলী ও কামরুন নাহার বীথির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দেশ রূপান্তর।
গতকাল মঙ্গলবার আবদুল গফুর সরকার টেলিফোনে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এরকম কোনো চিঠির তথ্য আমার জানা নেই। এরকম দুর্নীতির বিষয়েও আমি কিছু জানি না।’ বাকি দুজন, কামরুন নাহার বীথি ও মোহাম্মদ আলীর মোবাইলে ফোন করলেও এবং পরে বার্তা পাঠানো হলেও তারা সাড়া দেননি।
অভিযোগের বিষয়ে মুখ্য নৌ-নির্মাতা জিয়াউল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এরকম একটি চিঠি কয়েক মাস আগে এসেছে শুনেছি। তবে আমাকে দাপ্তরিকভাবে এখনো কিছু জানানো হয়নি। তদন্তাধীন বিষয়ে এর বেশি কিছু আমি বলব না।’
অভিযোগে বলা হয়, প্রধান প্রকৌশলী আবদুল গফুর সরকারের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটটি উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে সীমিত দরপত্রের মাধ্যমে কেনাকাটা করেছে। তারা মোট কেনাকাটার ৩৫ শতাংশ অর্থ ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ কাজ পাওয়ার আগে, ১০ শতাংশ কাজ পাওয়ার পরে ও বাকি ২০ শতাংশ অর্থ কাজ শেষে নিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন, এফএমসি, ওয়েস্টার্ন মেরিন, কর্ণফুলী, কুমিল্লা ও হাইস্পিড নামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুষের বিনিময়ে এ সিন্ডিকেটের কাছ থেকে জাহাজ বানানোর কার্যাদেশ পেয়েছে। আর খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী ঠিকাদাররা হলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহীন, টোটন, যুবলীগের রাজু, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মারুফ হোসেন রাজিব ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের জাহাঙ্গীর।
এর মধ্যে থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিনের বিরুদ্ধে মেঘনা ও ফুলদী নদীর একাংশ দখল করে জাহাজ নির্মাণ কারখানা করার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ বেশ কিছু গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে নদী উদ্ধারে আগ্রহ দেখায়নি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
অভিযোগ রয়েছে, থ্রি অ্যাঙ্গেলকে দুর্নীতির মাধ্যমেই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দুই প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭০ কোটি টাকার কাজ দিয়েছে। সে কারণে তাদের নদীর দখলদার থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন