কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি- কাফকোর চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) হাবিবুল্লাহ মঞ্জুর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, আর্থিক দুর্নীতিসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। তার নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা উঠে আসে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি আমাদের সময়ের হাতে পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিএফও কাফকোর অর্থ সরকারি ব্যাংকে না রেখে তার পছন্দমতো বেসরকারি ব্যাংকে জমা রেখে সুবিধা নিয়েছেন। এ ছাড়া পছন্দমতো স্থানীয় বীমা কোম্পানি নির্বাচিত করেও তিনি অনিয়মে জড়িয়েছেন। কাফকোর জন্য কাঁচামাল, কস্টিক সোডা, ইউএফ-৮৫ উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে (ওটিএম) না কিনে নির্বাচিত কয়েকটি সংস্থা ও দেশ থেকে কিনে অনিয়ম করেছেন। কাফকোর ক্ষতিগ্রস্ত জেটি মেরামতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়াই প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে বিশেষ সুবিধা নিয়েছেন। এ মেরামত কাজে ৭০ লাখ ডলার প্রদান করাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ নির্ধারিত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ৫০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে প্রাথমিকভাবে সম্মত ছিল বলে তদন্তে জানা গেছে। এটিও এখন অনিশ্চয়তার পথে। এর দায়িত্ব সিএফও হিসেবে তার ওপর বর্তায়। হাবিবুল্লাহ মঞ্জু সিএফও হিসেবে মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানকে মেরামত কাজের জন্য অর্থ প্রদানে মুখ্য দায়িত্ব পালন করায় তার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
একজন নারী কর্মকর্তা তার জবানবন্দিতে হাবিবুল্লাহর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। সিসিও রবিউল হক চৌধুরী এই অভিযোগের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এর আগে গণমাধ্যমে হাবিবুল্লাহ মঞ্জুর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য ও টেন্ডারে অনিয়মসহ বেশকিছু দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করে শিল্প মন্ত্রণালয়। ৩১ অক্টোবর কমিটি প্রতিবেদন দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কাফকোর সব ধরনের স্থানীয় বীমা এবং ব্যাংক আমানত নিজের পছন্দমতো ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে সেখান থেকে অবৈধভাবে কমিশন নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ। বাংলাদেশ সরকার, জাপান, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্কেও যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির আন্তর্জাতিক সব বীমা পদাধিকার বলে মোকাবিলা করেন হাবিবুল্লাহ মঞ্জু। সেখান থেকেও অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের কমিশন। মিসর, ওমান এবং সৌদি আরব থেকে কস্টিক সোডা এবং ইউএফ-৮৫ রাসায়নিক ক্রয়ের ক্ষেত্রেও বড় অংকের কমিশন নিয়ে থাকেন এবং ক্রয় আইন ও বিধি অনুসরণ করেন না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হাবিবুল্লাহ কাফকো থেকে বাড়তি বেতন সুবিধা নিতে আগের কর্মস্থল ডিবিএলে যা বেতন পেতেন তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেতন দেখিয়ে কাফকোতে নিয়োগ নিয়েছেন। একাধিক নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে যৌন হয়রানি করার বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কাফকোতে তিন বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পেলেও এখনো চাকরিতে বহাল আছেন। কাফকোতে নিয়োগের পর থেকে বিদেশ ভ্রমণ তার নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে। অকারণেই নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।
গত ২৬ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর কাফকোর ঢাকা অফিসে এবং ১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম অফিসে অভিযুক্ত এবং অন্য কর্মকর্তাদের জবানবন্দি নেয় তদন্ত কমিটি। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, সিএফও মঞ্জু কাফকোতে চাকরির জন্য জমা দেওয়া সিভিতে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে তথ্য গোপন করেছেন। এ ঘটনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কাফকোর একজন কর্মকর্তাকে অন্যায়ভাবে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগও রয়েছে মঞ্জুর বিরুদ্ধে।
একাধিক নারী কর্মকর্তা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেছেন, সিএফও তাদের বিভিন্ন সময় কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। রাজি না হওয়ায় তাদের চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে সিসিওর কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার মেলেনি। একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক বীমার বিষয়টি হাবিবুল্লাহ মঞ্জু এককভাবেই দেখাশোনা করেন এবং সুবিধা নিয়ে থাকেন। শুধু নিয়ম রক্ষার জন্যই পরোক্ষ অনুমোদন নেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বিসিআইসি ইউএফ-৮৫ কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করলেও কাফকো কখনো এটি কেনার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেনি। কাফকো প্রতিবছর বিপুল অংকের ইউএফ-৮৫ কিনে থাকে। তা কিনতে একটি বা দুটি কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাটা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
কর্মকর্তারা জানান, জাহাজের ধাক্কায় জেটির ক্ষতি নিরূপণের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। জেটি মেরামতের জন্য অন্তরা কোহ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার কাজের আগেই পরিশোধ করা হয়। আরও ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে কাফকো। কাফকো বোর্ডে মঞ্জুর সুপারিশে ৫ মিলিয়ন ডলার নিতে রাজি হলেও এখন পর্যন্ত তা আদায় করা হয়নি। জাহাজের কোম্পানি, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা কাফকো জেটি মেরামতে ৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার খরচকে অবিশ্বাস্যই বলেছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন