দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে চলছে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। গত চার বছরে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে সরকারও। প্রতি বছর ২২ অক্টোবর পালন করা হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এর মধ্য দিয়ে আসলে সড়কের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করা গেলো?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। দুর্ঘটনা বাড়ছেই। কারণ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সিস্টেমে গলদ রেখে উপরে কিছু কসমেটিক কাজ হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে যা করা দরকার, তার কিছুই করা হয়নি। এ বিষয়ে সহমত সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ বলছে, যা যা করা দরকার, সবই করা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে।
২০২০ সালে দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং সাত হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন বলে রোডটি সেফটি ফাউন্ডেশনের ‘সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২০’ এ বলা হয়েছে। ২০২১ সালে এটি আরও বেড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ও সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে হলে বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে সুশৃঙ্খল করতে হবে। মহাসড়কের পাশাপাশি শহরের ভেতরেও বিশৃঙ্খল অবস্থা। বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। সেখান থেকেই দুর্ঘটনা ও যানজট হয়। সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন করছে, চালকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু এটার সঙ্গে সঙ্গে আরও করণীয় আছে। রাস্তা ফিট হতে হয়, রেগুলার সেফটি অডিট করতে হয়, গাড়িটাও ফিট হতে হয়। এখন যে ফিটনেস প্রক্রিয়া বাংলাদেশে আছে- টাকাটা জমা দিলেই যে কোনো গাড়ি ফিটনেস পেয়ে যায়। এত স্বল্পসংখ্যক পরিদর্শক দিয়ে বিশালসংখ্যক গাড়ির সার্ভিস দেওয়া যায় না। এটা সরকারও জানে। ফলে একটা তামাশা হচ্ছে। গাড়ি না আনলেও ফিটনেস পাওয়া যায়। এই ফিটনেস প্রক্রিয়ায় বড় গলদ রয়ে গেছে।
‘ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার আগে তার দক্ষতা যাচাইয়ের কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির আশেপাশে নেই। গাড়ির তুলনায় চালক কম। রাস্তা আমাদের এলোমেলো, গাড়ির ফিটনেস প্রক্রিয়ায়ও গণ্ডগোল, চালক তৈরিরর পদ্ধতি শুদ্ধ নয়, বাজারে চালক নেই, তাও বিআরটিএ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে। অর্থাৎ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে এসব জায়গায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াগুলো থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে।’
বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, চরম বিশৃঙ্খল একটা সিস্টেম দিয়ে সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব নয়। করণীয় সহজ। বিনিয়োগবিহীন দরদ দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়। পথচারীবান্ধব ফুটপাত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও কন্ট্রাকলেস ফিটনেস দেওয়া, চালক তৈরি করার প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া করা, রাস্তার পাশের হাটবাজারে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।
‘সিস্টেমে গলদ রেখে উপরে কিছু কসমেটিক কাজ করে সড়ক নিরাপদ করা যাবে না।’ মনে করেন এ সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, কোনো রকম রেগুলেটরি অথরিটি নেই। আমাদের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা অরক্ষিত, গার্জিয়ানলেস। দুর্ঘটনা ঘটার যথেষ্ট রেসিপি আছে। এখন তো নতুন করে যুক্ত হয়েছে দুই চাকার অনিরাপদ যান। মোট গাড়ির ৫৫ শতাংশ মোটরসাইকেল। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর তরুণরা প্রতিদিন মারা যাচ্ছে বা বোঝা হচ্ছে। এটা আরও বাড়বে।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, মোটরসাইকেলকে পৃথিবীতে বলে অভিশাপ, এই অভিশাপ থেকে জাতি কখনো মুক্ত হয় না। সে কারণে নিরুৎসাহিত করা হয়। জাপান নিজ দেশে বিক্রি করতে পারে না, চলে এসেছে এই দেশে। কেন? আমরা কোনো কিছুই এখানে জানি না।
‘এখন সরকার যথেষ্ট পরিপক্ব। সরকারের দায়িত্ব আছে। অন্য দেশের পলিসি দেখা উচিত। সড়ক নিরাপদ করার জন্য নতুন কোনো প্রকল্পের প্রয়োজন হবে না। ধ্যান লাগবে, জ্ঞান লাগবে, আলোকিত পেশাদার লোক লাগবে।’
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন জাগো নিউজকে বলেন, এখনো সড়ক নিরাপদ হয়নি। বরং অনিরাপদ হয়েছে বেশি। গ্যাপটা হলো- কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, কী করলে দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে- গত ২৮ বছরে যত সরকার এসেছে, প্রত্যেককেই আমরা সেটি জানিয়েছি। অসুখ ধরেছি, ডায়াগনোসিস করেছি, কী ওষুধ লাগবে সেটিও বলেছি। কিন্তু এ সড়কের অসুখ সারানোর দায়িত্ব যিনি নেবেন বা যারা ওষুধ দেবেন, খাওয়াবেন, তারা কাজটা করছেন না।
তিনি বলেন, ২৮ বছর আমরা আন্দোলন করছি। ২০১৭ সাল থেকে সরকার দিবস পালন করছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য যে সাজেশন আমরা দিয়ে আসছি, সেগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সুফল পাবো না।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আগের যে সমস্যা ছিল, সেগুলো তো সমাধান হচ্ছেই না, বরং নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। যেমন- নসিমন-করিমন ভটভটি আসছে, ব্যাটারিচালিত গাড়ি আসছে। আগের গাড়িগুলোই যেন সঠিক ফিটনেস নিয়ে চলে, চালকরা যেন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে গাড়ি চালান এবং জনগণও যেন নিয়ম মেনে রাস্তায় চলেন, পারাপারে নিয়ম মেনে পার হন- এসব সমস্যা তো সমাধান হচ্ছেই না, নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। যে কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের মহাসচিব খোন্দকার এনায়ত উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, সড়ক পুরোপুরি নিরাপদ করা সম্ভব নয়। বিশ্বের কোথাও সড়ক পুরোপুরি নিরাপদ করতে পারে না। তবে সড়কে দুর্ঘটনার ব্যাপারে শুধু মালিক শ্রমিকরাই দায়ী নন। অনেক কিছু এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত। রোডের ব্যাপার থাকে, আরও বহু কিছু আছে। সবাই চেষ্টা করছে, নিরাপদ সড়ক করতে। সরকারি পর্যায়েও কাজ চলছে। অনেকগুলো ব্ল্যাক স্পটের মেরামত করা হয়েছে। অনেক রাস্তায় ডিভাইডার হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা কমছে।
বিআরটিএর পরিচালক (সড়ক নিরাপত্তা) শেখ মাহবুবে রাব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকার প্রতিটি সেক্টরে ইন্জিনিয়ারিং, এনফোর্সমেন্ট এডুকেশনের ওপর কাজ করছে। এরপরও দেশে যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, আপনাকে তো শুধু সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না, রেশিও হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যেভাবে রাস্তাঘাট, গাড়ি ও জনসংখ্যা বেড়েছে, সেভাবে রেশিও হিসেবে চিন্তা করলে অবশ্যই সড়ক নিরাপত্তা উন্নতি করেছে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিক বার গণমাধ্যমে বলেছেন, আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কমতি নেই। চ্যালেঞ্জ হলো- সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানো। এজন্য আমরা সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করেছি।
দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলকে দায়ী করে তিনি বলেন, মোটরসাইকেলও নিয়মের মধ্যে এনেছি। তারা এখন হেলমেট পরে।
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন ১৯৯৩ সালে ২২ অক্টোবর বান্দরবানে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। সেই থেকে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে ইলিয়াস কাঞ্চন নামেন পথে। ‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়’ স্লোগান নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সামাজিক আন্দোলন ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।’
নিসচার আন্দোলনের ফলস্বরূপ ২০১৭ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই বছর থেকেই বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়ে আসছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন