দেশের নদনদী দখল ও দূষণ রোধ এবং নাব্যতা বাড়াতে পরিকল্পনার অভাব নেই সরকারের। আছে ৬৩ হাজারের বেশি নদী দখলদারের তালিকাও। ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলোর নাব্যতা ফেরাতে রয়েছে মাস্টার প্ল্যান। রয়েছে দুটি টাস্কফোর্স ও বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প। এতকিছু থাকার পরও নদী দখল ও দূষণ কমছে না। ঢাকার চারপাশের নদীতে নানা ধরনের আবর্জনার ১০-১২ ফুট স্তূপ জমেছে। বিভিন্ন নদীর জমি দখল করে বহাল তবিয়তে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি অনেক সংস্থার স্থাপনা। দিনদিন দখলের সংখ্যাও বাড়ছে। করোনার কারণ দেখিয়ে ভাটা পড়েছে উচ্ছেদ অভিযানে। একই কারণে চলতি বছরে হয়নি নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সের বৈঠক।
শুধু তা-ই নয়, দখলদার বহাল রেখেই ঢাকার চারপাশের নদীর কয়েকটি স্থানে বসানো হচ্ছে সীমানা পিলার। নদী রক্ষা কমিশনের চিঠি দেওয়ার আড়াই মাস পার হলেও রাজধানীর আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন ও মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্টে বসানো পিলার অপসারণ এবং সেখানে অবৈধ দখলে থাকা জমি উদ্ধার করেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
আরও জানা যায়, দখল-দূষণ রোধে সারা দেশে বড় ধরনের অভিযান না থাকলেও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চলমান রয়েছে। ঢাকার চারপাশের নদীর তীরে ওয়াকওয়ে এবং বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছে। যদিও এসব কাজের মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। গত সাত বছরে ৩ হাজার ১৯১ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হয়েছে। নদীর দূষণ রোধে কেনা হচ্ছে বিশেষায়িত নৌযান।
নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নদী রক্ষায় সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। পানি আইন পাশ করেছে। অনেক প্রকল্প নিয়েছে। এতকিছুর পরও তা কার্যকর সুফল আনতে পারেনি। এজন্য আমব্রেলা প্রকল্প নেওয়া দরকার ছিল। সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, নদী দখল রোধে সুপ্রিমকোর্টের রায় আছে। তবুও নদী দখল ও দূষণ রোধে জনসচেতনতা এখনো পুরোপুরি তৈরি করা যায়নি। নদী দখলদারদের বড় অংশ প্রভাবশালী। তাদের উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসকরা সাহস পান না। আবার অনেক স্থানে প্রশাসনের লোকও দখলদারদের সঙ্গে মিলেমিশে যান। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ঢাকার চারপাশে যে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে তাতে ভাটা পড়ল কেন।
নদী রক্ষায় সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহণ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সারা বিশ্বই থমকে গিয়েছিল। এখন সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। আমরা নদী রক্ষায় যেসব পরিকল্পনা নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। নদীর নাব্যতা বাড়াতে সারা দেশে ড্রেজিং করা হচ্ছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর সীমানা রক্ষায় পিলার স্থাপন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকার চারপাশের নদী দখল-দূষণ রোধে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সেখানে আমাদের যা যা করণীয়, তা করা হচ্ছে।
সীমানা পিলার বিতর্কিত : জানা যায়, রাজধানীর আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন ও মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্ট এলাকায় ১৮টি সীমানা পিলার বসিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। নদী রক্ষা কমিশন ৩০ জুন এক চিঠিতে ওইসব পিলার বিতর্কিত উল্লেখ করে নৌসচিবকে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ওই এলাকায় নদীর তীরে যেসব সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে; যা মোটেও কাম্য নয়। এসব বিতর্কিত সীমানা পিলার নদনদীর অবৈধ দখলদারদের নদী দখলের সুযোগ করে দেওয়ার শামিল এবং সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করবে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের জমি ভরাট নিয়ে নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সুপারিশ লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে কোনো সংস্থা কর্তৃক কাজ করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
তবে এ চিঠি পাননি বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পিলার স্থাপন সংক্রান্ত চিঠি পাইনি। নদী রক্ষা কমিশনের একটি প্রতিবেদন পেয়েছিলাম। ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়ন কীভাবে করা যায়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নদীর সীমানা অনুযায়ী পিলার বসানো হচ্ছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা : জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে নদীর তীরে সাত কিলোমিটার এলাকায় সীমানা পিলার স্থাপন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণে টেন্ডার করেছে বিআইডব্লিউটিএ। ওই সাত কিলোমিটার কাজ বাস্তবায়ন করতে সিএস লাইনের মধ্যে ১০৯টি স্থাপনা পেয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫২টি। এই ৫২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ৪০০ ফুট, ওয়াসা ২৫০ ফুট, লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলস ৯৫০ ফুট, চিত্ররঞ্জন কটন মিলস ৬০০ ফুট ও সমবায় পাট মিল ৬০০ ফুট এলাকা নদীর সম্মুখভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ওই প্রতিবেদনে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি শিল্পগ্র“পেরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সূত্র জানায়, যেসব স্থানে বড় আকারে স্থাপনা নদীর জমিতে রয়েছে, সেগুলো বহাল রেখেই সীমানা পিলার বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। ওইসব প্রতিষ্ঠানকে সীমানা পিলার পর্যন্ত স্থাপনা সরিয়ে নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। যারা সীমানা পিলার স্থাপনে বাধা দিচ্ছে, শুধু তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএ-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, অভিযান চালালে বড় বড় শিল্পকারখানার সুনাম ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হবে। এ কারণে তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
অনেক পরিকল্পনায় আটকে আছে ঢাকার চারপাশের নদী : জানা যায়, ঢাকার চারপাশের নদী নিয়ে মাস্টার প্ল্যান করেছে সরকার। আর তা সমন্বয় করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর নাব্য বৃদ্ধি ও দখল-দূষণ রোধে ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণকাজ চলছে। এছাড়া সংগ্রহ করা হচ্ছে ২টি গ্রাব এক্সকেভেটর। বাকি সবকিছুই পরিকল্পনায় আটকে আছে। আর পরিকল্পনায় রয়েছে এ চার নদীর সীমানা চিহ্নিত করতে তৃতীয় পর্যায়ে ১৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নদী দূষণ রোধে শিল্পকারখানায় ইটিপি স্থাপন ও কম উচ্চতার সেতু সরিয়ে বেশি উচ্চতার সেতু প্রতিস্থাপন, গুরুত্বপূর্ণ অংশে ড্রেজিং করে পলি অপসারণ কার্যক্রম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন