ই-কমার্স কিংবা মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ঠেকাতে সরকার ঠিকমতো কাজ করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাই কোর্ট।
একই সঙ্গে আদালত প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আত্মসাত, পাচার করা অর্থ উদ্ধারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও।
ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের মধ্যে আরেকটি রিট আবেদনের শুনানিতে এই প্রসঙ্গে কথা বলে আদালত।
সারা দেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের শুনানি সোমবার চলছিল বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের ভার্চুয়াল বেঞ্চে।
শুনানিতে পি কে হালদার, পিপলস লিজিং, হল-মার্ক, ইভ্যালির প্রসঙ্গ উঠলে আদালত উষ্মা প্রকশ করে বলে, “আমার টাকাটা নিয়ে গেল, আর আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরব?
“এই তো তারা (যারা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, আত্মসাত করছে) থানায় যাবে, জেলে গিয়ে রাত্রে ঘুমাবে। কিন্তু আমার টাকাটা যে নিয়ে গেল সেটার কী হবে?”
গ্রাহকের করা প্রতারণার মামলায় সম্প্রতি ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জের মালিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের অর্থ দিয়ে পণ্য না পাওয়া গ্রাহকরা রয়েছেন অনিশ্চয়তায়।
এর মধ্যেই সারা দেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
সোমবার তার শুনানি হয়, এতে রিট আবেদনের পক্ষে সুমন নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক।
গত সোমবার প্রথামিক শুনানিতে আদালত ২০ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখে রিট আবেদনকারীর আইনজীবীর কাছে জানতে চেয়েছিল, দেশে কারা চড়া সুদের ব্যবসা করছে, কীভাবে ব্যবসা করছে?
সে অনুযায়ী আইনজীবী সুমন সম্পূরক আবেদনের মাধ্যমে সোমবার এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি থেকে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে শুনানিতে তিনি বলেন, ২০০৭ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি অবধি ৭৪৬টি প্রতিষ্ঠান-সংগঠনকে ক্ষুদ্রঋণের সনদ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি অবধি ১৩৪টি প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের সনদ বাতিল করা হয়েছে।
সুমন বলেন, “বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষদ্রঋণের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ছাড়া আর করো সুদের ব্যবসা করার সুযোগ নেই। কিন্তু সারা দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দেদারসে উচ্চহারে সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর শিকার হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এমনকি মধ্যবিত্তও।”
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “আপনি যে তাদের নিষ্ক্রিয়তা চ্যলেঞ্জ করেছেন, তারা তো সনদ বাতিল করেছে।”
আইনজীবী সুমন বলেন, “সনদ বাতিল হলেও তাদের ব্যবসা থেমে নেই। তাহলে সমাজে সুদের ব্যবসা কিভাবে হচ্ছে?”
তখন বিচারক সনদ বাতিল করা ১৩৪টা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণের কারবার করছে কি না, জানতে চাইলে আইনজীবী তা দেখাতে ব্যর্থ হন।
তিনি বলেন, মাইক্রোক্রেডিট অথরিটি চাইলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন, ২০০৬ এর ৩৪ ধারা অনুযায়ী কারা সুদের ব্যবসাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে ৪১ ধারা অনুযায়ী এ অথরিটির কাছে অন্য কেউ অভিযোগ করতে পারবে না। অভিযোগ করতে হবে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কর্তৃক্ষকে। এইসব কারণেই কিন্তু প্রতারক চক্র গড়ে উঠছে। মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
বিচারক আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান বলেন, “এই যে এত দুর্বল দেশ! এই দুর্বল দিক দিয়ে আমরা সরকারকে কী দিব, কী বলব? রাগীব (এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব এহসান) নামের এক হুজুর আগে শিক্ষক ছিল। শিক্ষকতার টাকা দিয়ে হচ্ছে না। তখন ইসলামের দোহাই দিয়ে সুদমুক্ত হালাল টাকা, গোনা-পাপ এই সমস্ত কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে।”
আইনজীবী সুমন তখন বলেন, “এগুলোই চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। এরা মানুষকে একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষগুলো পথে বসে যাচ্ছে।”
এরপর বিচারপতি বলেন, “এই ইস্যুটা আমাদের আরও গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। আমরা শুনেছি, বিষয়টা আমরা দেখব। একটা-দুইটা পত্রিকার রিপোর্ট দিয়ে হবে না। আরও অনেক কিছু দেখতে হবে। এটা খুবই জটিল বিষয়। এর সাথে কোন অথটিরিট জড়িত, কী কী আইন আছে, সব দেখতে হবে।”
এসময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর-উস সাদিক বলেন, অনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর রুল হতে পারে না। কার উপরে এ অভিযোগ আনা হয়েছে? কারা এই কাজগুলো করছে তাদের নামগুলো সুনির্দিষ্ট করার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তারা প্রতিকার চাইতে পারে।
জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, “সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যাদের কোনো রেজিস্ট্রেশন নাই, তারা দেশ থেকে চলে গেল। টাকা চুরি করে সাফ করে দিয়ে গেল। কে কোথায় কত সালে কত হাজার টাকা নিয়ে গেল, এই যে নিয়ে গেল, আমাদের রাস্তাগুলো খোলা কেন? আমার বাড়ি অরক্ষিত কেন?
“আমার বাড়ি মানে বাংলাদেশ। দেশের মানুষ দরজা জানালা বন্ধ করে শান্তিতে ঘুমাবে, কিন্তু আমার ঘর কেন অরক্ষিত? আমাদের ঘরের দরজাগুলা কেন খোলা? মানুষের টাকা কেন লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে? এই দরজাগুলো খোলা কেন? কাদের দায়িত্ব এই দরজাগুলো বন্ধ করার, এগুলো আমরা একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাই। এ বিষয়ে আমরা একটি রুল দিতে চাই। আমরা দেখে শুনে আদেশ দেব।”
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুর উস সাদিক তখন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান, ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান-ব্যবস্থাপনা পরিচালককে গ্রেপ্তারের কথা বললে উষ্মা প্রকাশ করে আদালতের বক্তব্য আসে।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, “সরকার তো ব্যবস্থা নিচ্ছে, কখন? যখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, তখন। আমার প্রতিকারটা কোথায়?
“আমার টাকাটা নিয়ে গেল। আর আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরব? এই তো তারা থানায় যাবে, জেলে যাবে, রাত্রে ঘুমাবে। কিন্তু আমার টাকাটা যে নিয়ে গেল সেটার কী হবে?”
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাদিক বলেন, “চুরির পরে মামলা হচ্ছে। চুরি তো হচ্ছেই। চুরির বিষয়ে আইন আছে। কিন্তু চুরি তো ঠেকানো যাচ্ছে না।”
বিচারক তখন বলেন, “সরকারের চাওয়া কী? এদেশের এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, তাদের আইনের শাসন সমস্ত কিছু তারা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আমরা সরকারের কাঠামোগুলো ঠিকমত কাজ করছে কি না, কেন করছে না সেটি দেখার জন্যই এখানে বসেছি।
“আমরা এই মামলাটি আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য রখলাম, বিষয়টা জটিল। দেখে আদেশ দেব।”
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন