একটি ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরে নির্মাণ করা হচ্ছে ৫০ ফুট প্রস্থের দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্য একটি সড়ক। যেটি বাঁধ হিসেবেও ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে তিস্তার বাম চ্যানেল প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদ থেকে শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা। তারা বলছেন, চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হলে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক নদী-ভাঙনসহ সম্পদহানি দেখা দিতে পারে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীতে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ারের সঙ্গে পৃথক দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পরবর্তী সময়ে ইন্ট্রাকোর শেয়ার কিনে নেয় প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান।
চুক্তি অনুযায়ী রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরপার্ক গড়ে তোলার কথা ছিল। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১২ টাকা ৮০ পয়সা দামে ২০ বছর ধরে কেনার কথা পিডিবির। প্রায় চার বছরেও প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যেতে পারেনি। এখন পিডিবির কাছে স্থান পরিবর্তনের আবেদন করেই লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার শৌলমারীতে কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। আর মূল প্রকল্পে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের জন্য তিস্তার বাম চ্যানেল প্রায় বন্ধ করে রাস্তা তৈরি কাজ করছে ওই প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তাতে পানির গতিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হবে। এতে ডান-তীরসহ বিভিন্ন স্থানে নদী-ভাঙনসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে।’
এই প্রকল্পের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি ও কোনো মতামত চাওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
গত ২০ মে লালমনিরহাট পাউবোর একটি দল সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরে তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়— তিস্তা নদীর বাম তীরের প্রায় দুই কিলোমিটার অভ্যন্তরে ইন্ট্রাকো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে এবং প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে ৫০ ফুট প্রস্থের একটি রাস্তা ও দুটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে প্রকল্প এলাকাটি একসময় নদীর মূল প্রবাহ ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে ওই স্থানে নদীটি দুই ধারায় (চ্যানেল) বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যেখানে (বাম তীর) রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে বর্ষাকালে প্রায় দেড় কিলোমিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে অন্তত দুটি ধারা প্রবাহমান থাকে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তিস্তার বুকে সড়ক, ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কা
সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য বাম চ্যানেল প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়— চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হলে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক নদী-ভাঙনসহ সম্পদহানি দেখা দিতে পারে। আর বাম চ্যানেলের পানি ডান চ্যানেলের পানির সঙ্গে মিশে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আরও বিস্তৃত হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সমন্বয় থাকা প্রয়োজন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা নদীর (বাম চ্যানেল) মাঝখানে বেইলি ব্রিজের জন্য কিছুটা জায়গা রেখে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। নদী পেরিয়ে চরের বুকে তৈরি ইট বিছানো রাস্তাটি চলে গেছে প্রকল্প এলাকায়। বালুভর্তি শত শত জিও ব্যাগ রেখে দুই পাশে ইট-রড দিয়ে ‘সাইড ওয়াল’ তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার কারণে চরের মাঝে পানি আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে অনেক জমিতে। ফলে সেখানে এখন পর্যন্ত আমনের চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি।
তিস্তা তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাস্তা বা বাঁধের কারণে পানি বাধাগ্রস্ত হয়ে উজানে কালীগঞ্জের দুটি ও হাতীবান্ধা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে অনেকে বসতবাড়ি ও আবাদি জমি হারিয়েছেন।
আরও দেখা গেছে, দক্ষিণ ভোটমারী গ্রামের নদী তীরবর্তী এলাকার বিস্তীর্ণ আবাদি জমি ইতোমধ্যেই নদীতে চলে গেছে। গ্রাম থেকে চরের দিকে যাওয়া একটি কাঁচা রাস্তারও অনেকাংশ ভেঙে গেছে পানির চাপে। ধীরে ধীরে নদী এগিয়ে আসছে গ্রামের দিকে।
গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী বলেন, ভাটিতে বাঁধ দেওয়ায় নদীর পানি আটকে আমাদের এলাকার জমিজমা নদীতে চলে যাচ্ছে। আমন ক্ষেতসহ জমিজমা এখন যেন নদীর রূপ ধারণ করেছে। আমাদের মতো গরিব মানুষের এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তিস্তার বুকে সড়ক, ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কা
একই এলাকার মো. মমিনুর বলেন, উজানের জমিজমা সব শেষ হয়ে যাচ্ছে ইন্ট্রাকোর রাস্তা নির্মাণের কারণে। চারবাসী জানান, প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার কারণে পানি আটকে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, এ জলাবদ্ধতার কারণে এবার অনেকে নিজের জমিতে আবাদ করতে পারেননি।
শৌলমারী গ্রামের গৃহবধূ মমিনা বেগম বলেন, ‘ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের জমি যেমন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আবার যেটুকু আছে তাও জলাবদ্ধতার কারণে আবাদ করা যাচ্ছে না।’
নদীতে রাস্তা তৈরি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রিভারাইন পিপলসের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘নদীর অভ্যন্তরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে নদীর মারাত্মক ক্ষতি হবে। যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, সে সময় নদীটির ভেতরে যে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে, তাতে নদী, মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি হবে।’
‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ আন্দোলন পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ‘এ সব প্রকল্প করে আমাদের জীবনকে ধ্বংস করছে, মানুষকে বিপর্যস্ত করছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড আর প্রশাসন কিছুই জানে না ‘
ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের পক্ষে প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেডের কর্মকর্তা মেজবা আজিজ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, নদীর বুকে রাস্তা নির্মাণে গতিপথের কোনো ক্ষতি হবে না। নদীর পানি যাতে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে, সেজন্য দুটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।
তিস্তার বামতীর অপরিকল্পিতভাবে বন্ধের বিষয়টি গত ১৩ জুন জেলা পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় তুলে ধরেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পাউবো)।
তিনি জানান, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে নদীর বামতীর আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির ‘অ্যাসেসমেন্ট’ করা হয়েছে কি না, সেটিও পাউবোকে জানানো হয়নি। এই সভাতেও ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার অনুরোধ জানান তিনি। একটি কমিটি গঠন করে সরেজমিনে তদন্ত শেষে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
ওই কমিটির সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এই কমিটিতে আমাকে রাখা হয়েছে কি না, তা আমি কিছুই জানি না। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।’
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন