গুস্তাভ ট্রুভে অ্যাওয়ার্ড-২০২১ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি সোলার বোট আয়রন। বৈদ্যুতিক নৌযান প্রতিযোগিতার একমাত্র আন্তর্জাতিক আসরের এই প্রতিযোগিতার কাস্টমাইজ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ নৌযান হিসেবে বিজয়ী হয় আয়রন। অসংখ্য মানুষের ভোট এবং বোট অ্যাসোসিয়েশনের বিচারক প্যানেলের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এই অর্জন লাভ করেছে বাংলাদেশ। সারাবাংলা
গুস্তাভ ট্রুভেকে বলা হতো ফ্রান্সের আলফা এডিসন। টেসলা গাড়ি রাস্তায় নামার ১২৯ বছর আগে গুস্তাভ ট্রুভে তৈরি করেন প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি। ১৮৮১ সালে তিনি প্রথম ইলেকট্রিক-আউটবোর্ড মোটর তৈরি করেন এবং সেই মোটর দিয়ে প্যারিসের সেইন নদীতে ভাসে পৃথিবীর প্রথম বিদ্যুৎচালিত নৌযান।
অসংখ্য আবিস্কারের সঙ্গে ইলেকট্রিক বোটের আবিস্কারক হিসেবে গুস্তাভে ট্রুভোর সম্মানে ২০২০ সাল থেকে শুরু হয় পৃথিবীর প্রথম ইলেকট্রিক-বোট প্রতিযোগিতা এবং এক্ষেত্রে বর্তমানে এটাই একমাত্র আন্তর্জাতিক আসর।
ইলেকট্রিক গাড়ির মতো ইলেকট্রিক নৌযান বানানো সহজ না হলেও রয়েছে তার কিছু সুবিধা। নৌযানের আকৃতি বড় হওয়ায় সোলার প্যানেল লাগানো সম্ভব। এসব কথা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের একজন নাবিক ক্যাপটেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ পরিকল্পনা করেন বৈদ্যুতিক নৌযান ‘আয়রন’ তৈরি করার।
শুরুর কথা বলতে গিয়ে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “এটির ডিজাইন করেছেন ফ্রান্সের মাইকেল ও’কনর। কিন্তু পরিকল্পনা এবং ডিজাইনের চেয়ে দূরহ ব্যপার হয়ে দাঁড়ায় আমাদের দেশে এর নির্মাণ। কারণ এরকম নৌযান আগে কখনও তৈরি হয়নি। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মইনুল এগিয়ে আসেন প্রযুক্তিগত ব্যাপারটি দেখার জন্য, আর আইটি এক্সপার্ট ইউসুফ নুতন করে পড়াশুনা এবং গবেষণা শুরু করেন ইলেকট্রনিক্স নিয়ে শুধু এ নৌযান তৈরির জন্যই। আর হাতুড়ি বাটাল আর দুজন কাঠমিস্ত্রি নিয়ে আমি শুরু করি বোট তৈরি। পুঁথিগত বিদ্যা, মাইকেল ও’কনর এর সঙ্গে ভিডিও চ্যাট, মইনুল এবং ইউসুফের গবেষণা, এসব কিছুর সমন্বয়েই ধীরে ধীরে রূপ নেয় দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎ চালিত ক্যাটামারান আয়রন।”
তিনি বলেন, “আয়রন জলে ভাষার পরপরই ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক ইলেকট্রিক বোট কম্পিটিশন। এশিয়া থেকে একমাত্র প্রতিযোগী হিসেবে কেরালা সরকারের মালিকানাধীন এবং ভারত ও ফ্রান্সের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ইলেকট্রিক ফেরি ‘আদিত্য’ অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতার একটি ক্যাটেগরিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে সেটি। ভারতের সমস্ত মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত খবরটি চোখে পড়লে আমি যোগাযোগ করি গুস্তাভ ট্রুভে এওয়ার্ড এর আয়োজকদের সঙ্গে। সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে এবং কাস্টমাইজ ডিজাইনের নৌযানটি দেখে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং আশ্বাস দেন পরবর্তী প্রতিযোগিতায় কাস্টমাইজ ক্যাটাগরি সংযুক্ত করা হবে।”
পরবর্তীতে এবছর জুনের প্রথম দিকে আয়োজকরা একটি মেইল করেন যে প্রথম ইলেকট্রিক বোটের ১৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নমিনেশন শুরু হয়েছে, আগ্রহী হলে নমিনেশনের জন্য আবেদন করতে পারেন। নমিনেশনের জন্য একটি ওয়েবসাইট থাকতেই হবে, যা আয়রনের নেই। ইউসুফ ও মাহমুদ মিলে রাতারাতি কাজ চালানোর মত একটি ওয়েবসাইট দাঁড় করান, আর একদম শেষ মুহূর্তে রেজিস্ট্রেশন করা হয় মনোনয়নের আশায়।
১৫ জুন জানানো হয় যে বোটটি কাস্টমাইজ ক্যটাগরির ১৭ বোটের মধ্যে প্রাথমিক ভোটিং এর জন্য মনোনীত হয়েছে। এরপর শুরু হয় ভোটিং ক্যাম্পেইন। ভোটিং এর মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ের জন্য বেছে নেওয়া হবে স্বল্প সংখ্যক ভোট।
৫ জুলাই প্রথম পর্যায়ের ভোট শেষে চূড়ান্ত পর্যায়ের ৬টি বোটের মধ্যে জায়গা করে নেয় আয়রন, আর শুরু হয় নতুন স্বপ্ন দেখা। কিন্তু এবার শুধু ভোট নয়, মুখোমুখি হতে হবে বিচারকদের। বিচারক প্যানেল চুড়ান্ত পর্যায়ের ভোটের পর বিজয়ী নির্ধারণ করবেন।
২৬ এপ্রিল চূড়ান্ত পর্যায়ের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা ছিল বিচারকদের যাচাই বাছাই। আর সবশেষে দিবাস্বপ্নকে বাস্তব করেই আয়রন জিতে নেয় কাস্টমাইজ ক্যাটাগরির বিজয় মুকুট। আয়রন বাদে বাকি বিজয়ীরা সবই ইউরোপ এবং আমেরিকার।
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, গত বছর ভারত থেকে পুরস্কৃত হওয়া ‘আদিত্য’ ভারত ও ফ্রান্সের দু’টি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত। সে হিসেবে শুধু বাংলাদেশ নয়, এমেরিকা এবং ইউরোপের বাইরে আয়রনই একমাত্র বোট, যা সম্পূর্ণ স্থানীয়ভাবে এবং ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মিত হয়ে জিতে নিয়েছে গুস্তাভ ট্রুভে অ্যাওয়ার্ড।
এই বোটের উপকারিতার কথা উল্লেখ করে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘ইলেকট্রিক বোট পাশ্চাত্যে আভিজাত্যের ব্যাপার হলেও আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশেও এর উপযোগিতা ব্যপক। সোলার-ইলেকট্রিক নৌযান চালাতে কোনো খরচ নেই। অবারিত সূর্যালোকে সে দিনভর চলতে পারে সম্পূর্ণ সৌরশক্তিতে। এছাড়া হাওর, কাপ্তাই হ্রদ, হাতিরঝিল, সুন্দরবনের মত পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এর মত উপযোগী কিছুই নেই। কারণ এর নেই কোনো শব্দ, নেই কোন ধোঁয়া, নেই কোন কম্পন।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে ইলেকট্রিক বোটের বাজার প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার, ২০৩০ এর দিকে তা হয়ত ২০ বিলিয়ন অতিক্রম করবে। এছাড়াও ক্ষুদ্র নৌযানের রয়েছে কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের বাজার। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি এবং রফতানি হলেও ক্ষুদ্র নৌযানের ক্ষেত্রে আমরা এখনও আদিমযুগে। ক্ষুদ্র নৌযান নির্মাণশিল্প সম্পূর্ণ মানবশক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই ক্ষুদ্র নৌযান শিল্প হতে পারে দেশের শ্রমশক্তি ব্যবহারের নতুন ক্ষেত্র। গুস্তাভ ট্রুভে এওয়ার্ড শুধু একটি অর্জনই নয়, এর মাধ্যমে হয়ত প্রথমবারের মত বাংলাদেশ নামটি পরিচিত হবে ক্ষুদ্র নৌযান নির্মাণশিল্পের বিশ্ব বাজারে, হয়ত খুলে দেবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন