টানা ভারী বর্ষণ ও পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়েছেন কক্সবাজারের চকরিয়ার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার প্রায় ৮০ শতাংশই এখন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ ১০ ফুট পর্যন্ত এলাকা তলিয়ে রয়েছে বানের পানিতে। হাজার হাজার বাড়িঘরের চালা পর্যন্ত ডুবে গেছে পানিতে।
বন্যার ভয়াবহতা থেকে জান বাঁচাতে প্রায় লাখো মানুষ, গবাদী পশু বিভিন্ন উঁচু সড়ক, ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দোতলায়, সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে। মাতামুহুরী নদী তীরের প্রতিরক্ষা বাঁধগুলোর বিভিন্ন স্থানে ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে ব্যাপক এলাকায় হু হু করে প্রবেশ করছে বানের পানি।
এদিকে, উপজেলার চিংড়িজোনের প্রায় ২০ হাজার একর চিংড়িঘের, পাঁচ শতাধিক পুকুরের মৎস্য প্রকল্প তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। একই অবস্থায় পাশের উপজেলা পেকুয়াতেও। সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নের লাখো মানুষ বানের পানিতে ভাসছে।
এই অবস্থায় একেবারে ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ গাছ-বাঁশের ভেলা ও নৌকায় চেপে যাতায়াত করছেন। টিউবওয়েল এবং বাড়ি পানিতে ডুবে থাকায় চুলোয় হাড়িও চড়ছে না। এতে বন্যাকবলিত মানুষগুলোর মাঝে দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট।
উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে শুকনো ও রান্না করা খাবার বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে বিতরণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এই পরিস্থিতিতে নানামুখি সংকটের মধ্যে পড়ছেন বানভাসি মানুষগুলো।
সরজমিন বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়া পৌরসভা ছাড়াও উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী, কৈয়ারবিল, হারবাং, বরইতলী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী এবং পেকুয়ার সদর, বারবাকিয়া, শীলখালী, রাজাখালী ও টৈটং ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম বানের পানিতে তলিয়ে গেছে।
বন্যাকবলিত ইউনিয়নগুলোর জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার বসতবাড়িগুলো ছাড়া নিন্মাঞ্চলের প্রায় শতভাগ এলাকা বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। বসতবাড়ির চালা পর্যন্ত ডুবে থাকায় হাজার হাজার পরিবারের সদস্যরা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন।
স্বেচ্ছাসেবী কয়েকটি সংগঠনও সাধ্যমতো শুকনো ও রান্না করা খাবার নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। স্বাধীন মঞ্চের পক্ষ থেকে বন্যার্ত দেড় হাজার পরিবারে রান্না করা বিরিয়ানীর প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে গতকাল। এছাড়াও কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বুধবার রাত থেকে অদ্যাবদি রান্না করার খাবার বিতরণ করেছেন প্রায় দশ হাজার পরিবারে। তার এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার ৮০ শতাংশ এলাকা বানের পানিতে ভাসছে। এই পরিস্থিতিতে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য দুইদফায় ১৮ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ১১০ টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও শুকনো খাবার হিসেবে তাৎক্ষণিক বিতরণের জন্য দেওয়া হয়েছে ১২০ বস্তা চিড়া, ১০০০ কেজি গুঁড়, ২০০ কেজি খেঁজুর, প্রয়োজনমতো পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে চকরিয়ার ইউএনও জানান, সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ইউনিয়নে অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এখনো কোথাও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
পেকুয়ার ইউএনও মো. মোতাচ্ছেম বিল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারিভাবে বন্যার্তদের জন্য ১৫ টন জিআর চাল, বিভিন্ন শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। যেখানে সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবারের বন্যায় যাতে কোনো মানুষ অভুক্ত না থাকেন, সেজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সরকারিভাবে। এছাড়াও আমি ব্যক্তিগতভাবে বুধবার রাত থেকে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছি বন্যার্তদের কাছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন