বঙ্গবন্ধু সেতু দেশে চলমান সেতুগুলোর মধ্যে দীর্ঘতম। যমুনা নদীর বুকে গড়ে ওঠা এ সেতুর টোলের হার বাড়ছে। বিদ্যমান করোনাকালে এর সঙ্গে বাড়ছে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতুর টোলও। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের বোর্ডসভায় এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে তা কবে থেকে কার্যকর হবে, তা নির্ধারণ হয়নি। আভাস দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের অক্টোবর বা নভেম্বর থেকে কার্যকরের। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সম্মতির জন্য সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে।
গতকাল সকালে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের বোর্ডসভায় তিনটি সেতুর টোল প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর টোল হারের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এটি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
গত বছরও বোর্ডসভায় টোলের হার বৃদ্ধি করার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছিল। করোনার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সেটি স্থগিত করা হয়। এখনো এ মহামারীর তা-ব চলছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভালো নয়।
গত বছরের ১৯ নভেম্বর সেতু কর্তৃপক্ষের ১০৯তম বোর্ডসভায় বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল বৃদ্ধির প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। সূত্রমতে সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে উদ্ভূত আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে টোল বৃদ্ধির প্রস্তাব আপাতত স্থগিত রেখে বাস্তবতার নিরিখে ২০২১ সালে পরবর্তী বোর্ডসভায় পুনরায় উপস্থাপন করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তারপুর সেতুর বর্তমান টোল হার ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি, বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল হার গড়ে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি এবং নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর টোল হার বিদ্যমান ফেরি পারাপারের দেড়গুণ প্রস্তাব করা হয়।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল প্রস্তাব অনুমোদন দিলেও অক্টোবরের আগে তা কার্যকর হচ্ছে না। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্রস্তাবটি কার্যকর হলে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতুর টোল হার মোটরসাইকেল ৪০ টাকা থেকে হবে ৫০ টাকা। এভাবে কার, জিপের টোল ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫০ টাকা। দেড় টনের ওজনবাহী মাইক্রোবাস ও পিকআপের ক্ষেত্রে টোল হবে ৫০০ থেকে বেড়ে ৬০০ টাকা, ছোট বাস হলে ৬৫০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫০ টাকা। বড় বাসের টোল ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা, ছোট ট্রাকের বর্তমান টোল ৮৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার টাকা, মাঝারি ট্রাক হলে বিদ্যমান ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ২৫০ টাকা, ৮ টন থেকে ১১ টনের ট্রাক হলে ১ হাজার ৪০০ টাকার টোল হবে ১ হাজার ৬০০ টাকা। ৩ এক্সেলের ট্রাকের জন্য নতুনভাবে ২ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে এ ধরনের ক্যাটাগরি ছিল না। যেমন ছিল না ট্রেইলারের নাম। এখন ৪ এক্সেল পর্যন্ত ট্রেইলার হলে ৩ হাজার টাকা এবং এর বেশি টোলের পরিমাণ ৩ হাজারের বেশি নির্ধারিত হবে এক্সেলপ্রতি ১ হাজার টাকা হিসাবে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে চলাচলকারী ট্রেনের জন্য বছরে ৫০ লাখ টাকা টোল দিতে হয়। নতুন প্রস্তাবে তা বছরে ১ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুটি মুক্তারপুর সেতু হিসেবে পরিচিত। এর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৫২ কিলোমিটার। এ সেতুতে ভ্যান বা মোটরসাইকেলে বর্তমানে ১০ টাকা টোল নেওয়া হয়। এই টাকাই নেওয়া হবে নতুন হার অনুমোদন পেলেও। তবে বাড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিশার টোল। ২০ টাকার পরিবর্তে ৩০ টাকা। এ ছাড়া কার/টেম্পো হলে ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা, জিপ/মাইক্রোবাস হলে ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা, ছোট বাস হলে ১০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০ টাকা, বড় বাস হলে ২০০ টাকার বদলে ২৫০ টাকা। আর ছোট ট্রাক ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০ টাকা ও ৮ টনের অধিক এবং ১১ টন পর্যন্ত ওজনবাহী ট্রাক হলে ৫০০ টাকার টোল হবে ৬০০ টাকা। এভাবে ৩ এক্সেল পর্যন্ত ট্রাকে নতুনভাবে প্রস্তাব করা হয় ৮০০ টাকা। ৪ এক্সেল পর্যন্ত ট্রেইলার হলে গুনতে হবে ১ হাজার টাকা। এর বেশি হলে ১ হাজার টাকার সঙ্গে এক্সেলপ্রতি ৫০০ টাকা যোগ হবে। এসব প্রস্তাব নতুন করে যুক্ত করা হয়। এসব বাহনের আগের টোল হার উল্লেখ ছিল না।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বোর্ডসভায় অংশ নেন। গতকালের বৈঠকে সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ২০২২ সালের জুন নাগাদ পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। ইতোমধ্যেই ৪১টি স্প্যানের সব কয়টি সফলভাবে স্থাপন করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত মূল সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি প্রায় ৯৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। নদী শাসনকাজের অগ্রগতি ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ।
নির্মাণাধীন এ সেতুটির টোল হার গতকাল প্রস্তাব করেছিল সেতু কর্তৃপক্ষ। তাদের প্রস্তাবনায় বলা হয়, মোটরসাইকেল টোল হবে ১০০ টাকা। এভাবে কার, জিপের জন্য ৭৫০ টাকা, পিকআপ, স্টেশন ওয়াগন, প্রাডো, নিশান ও লাক্সারি জিপের জন্য টোল হবে ১ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া মাইক্রোবাসের জন্য ১ হাজার ৩০০ টাকা, ছোট বাসের জন্য ১ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসের জন্য ২ হাজার টাকা, বড় বাসের জন্য ২ হাজার ৪০০ টাকা টোল হার প্রস্তাব করা হয়। ছোট ট্রাক ৫ টন পর্যন্ত হলে ১ হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ৫ থেকে ৮ টন পর্যন্ত হলে ২ হাজার ১০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টন ওজনবাহী হলে সেই ট্রাকের টোল হবে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এভাবে ৩ এক্সেলের ট্রাকের টোল গুনতে হবে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ট্রেইলার ৪ এক্সেল পর্যন্ত পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে গুনতে হবে ৬ হাজার টাকা। আর ৪ এক্সেলের বেশি হলে ওই ৬ হাজার টাকা টোলের সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য লাগবে অতিরিক্ত ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে সেতু কর্তৃপক্ষের এ প্রস্তাব আপাতত বোর্ডসভা অনুমোদন দেয়নি। পরবর্তী সময়ে আবার উত্থাপনের জন্য বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল হার ১৯৯৭ সালে নির্ধারণ করা হয়। এর ১৪ বছর পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে টোল ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। আর ২০০৮ মালে মুক্তারপুর সেতুর টোল নির্ধারণের পর এ পর্যন্ত আর বাড়ানো হয়নি। তবে রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য অনেক ব্যয়ের যুক্তিতে ২০১৭ সালে সেতু কর্তৃপক্ষের করা একটি কমিটি এ দুটি সেতুর টোল বাড়ানোর সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে টোল বাড়ানোর প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠালে সেখান থেকে সম্মতি আসে ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ। একই বছরের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাবটি পাঠানো হয়। তবে সেটি আর ফেরত আসেনি। তাই নতুন করে টোল বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করে সেতু বিভাগ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত আরেকটি প্রতিবেদন জমা দেয় নয় সদস্য নিয়ে গঠিত এ সংক্রান্ত একটি কমিটি।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, ডেবিট সার্ভিস লায়াবিলিটি (ডিএসএল) বাবদ প্রতিবছর প্রায় ২৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। বৈদেশিক মুদ্রার হারের পরিবর্তনের কারণে তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তা ছাড়া টোল থেকে আয়ের ওপর ৩২ শতাংশ হারে ভ্যাট ও ট্যাক্স সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন