মহামারি করোনা বিশ্বকে মৃত্যুপুরীতে পরিনত করেছে। থামিয়ে দিয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। চীনের উহান থেকে ভাইরসাটির উৎপত্তি হয়ে খুব অল্প সময়ে ছড়িয়ে পরে সারাবিশ্বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে মহামারি হিসেবে ঘোষাণা দেয়। এক অদৃশ্য শত্রুর সাথে শুরু হয় লড়াই। এই লড়াইয়ের প্রথমদিকে নাজেহাল হয় বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোও। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকে। প্রতিদিন প্রাণ হারাতে থাকে লাখ লাখ মানুষ। এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্য সচেতনতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একের পর এক দিক নির্দেশনা দিতে থাকে। মহামারি রুখতে সকলকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার উপর জোর দেয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। এতে সফলতাও আসে। করোনায় দিশেহারা হয়ে পরা দেশগুলো তাদের নাগরিকদের টিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সফলতা লাভ করে। বলা যায় বিশ্ব এখন মহামারি করোনা জয়ের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু ঠিক উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। সারা বিশ্বে যখন করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার নিম্মমূখী তখন বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত দুটোই বাড়ছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও ৫৪ জন মারা গেছেন। গতকাল (রোববার) মৃত্যু হয় ৪৭ জনের। দেশে ২৪ ঘন্টায় নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫০ জন। যা গত দেড় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সারাবিশ্বের দৈনিক কোভিড সংক্রমণ গত বছর ৪ঠা সেপ্টেম্বর ৩ লক্ষ অতিক্রম করে যা ক্রমে ৯ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। সংক্রমণের এই হার কমতে কমতে গতকাল প্রথম এ সংখ্যা ৩ লক্ষের নীচে নেমে আসে (২৯৭,৬০৭)। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা এ বছরের ২০শে জানুয়ারি ছিল ১৭,৪৯৫ জন যা কমে গতকাল ৬৫১৯ জনে নেমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক সংক্রমণও ৩ লক্ষাধিক ছিল গতকাল যা নেমে এসেছে ৫হাজর ২০০ জনে, দৈনিক মৃত্যু ৪৪৬৪ থেকে কমে গতকাল ছিল ১০০ জন। ভারতেও বেশ উন্নতি হয়েছে। যা আজ গত ৭২ দিনের মধ্যে কমে ৭০ হাজারে নেমে এসেছে। এছাড়া গতকাল মৃত্যুও ছিল কম ১৭৬১ জন।
তারা সবাই ভ্যাকসিনের উপর ভরসা করে এগোচ্ছে, নিজেরা উৎপাদন করছে, বিদেশ থেকে আমদানি করছে। আর আমরা শুরু থেকেই ভারতের কাছে জিম্মি হয়ে ভ্যাকসিন নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছি। ভারত আমাদের পরম বন্ধু এমন হাবিজাবি দাবি তুলে সকলের থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল ভারতের দারস্থ হয়ে থেকেছি। ভারত আমাদের পরম বন্ধুত্বের নমুনা হিসেবে টাকা নিয়েও ভ্যাকসিন দিচ্ছেনা। দিশেহারা হয়ে এখন দয়াদাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। অবশেষে দেনদরবার করে কিনা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী চীনের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি হয়েছে, অথচ চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে অংশ নিলে আমরা অনেক আগেই চীনা ভ্যাকসিন বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে পেতাম। এর মধ্যে আবার তথ্য ফাঁস করে চীনের প্রতিশ্রুত দের কোটি টিকা প্রাপ্তিতে বিপত্তি বাধিয়েছি। এখন ১০ ডলারের টিকা কত দামে কিনতে হবে তা মন্ত্রীরাই ভাল বলতে পারবেন কিন্তু এর মূল্য দিতে হবে জনগনকে।
নিট ফল হলো, সারাবিশ্বে যখন সংক্রমণ ও মৃত্যু পড়ন্ত, আমাদের তখন বাড়ন্ত। এতে সরকারের কোন দায় নেই। সরকারের ভাবখানা এমন যে কোভিড সতর্কতা না মেনে কেউ সংক্রমিত হলে, মারা গেলে, সরকার দায়ী হবে কেন?
দেশের করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এমন বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী যে সরকারের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর খামখেয়ালীপনা তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। শুরু থেকেই একের পর এক কেলেঙ্কারী-কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন কর্তাব্যাক্তিরা।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর চিকিৎসা ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতির যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে বিস্ময়কর নানা তথ্য পাওয়া গেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকিজি এবং সাহাবউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতি কাণ্ডে চাপা পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা, চিকিৎসার মান বাড়ানোসহ সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা। বরং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, করোনা চিকিৎসার বেহাল দশায় হাসপাতালবিমুখ হয়ে পড়েছে মানুষ। বিশেষজ্ঞ মতামত উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলা নির্ভরতার কারণে অব্যবস্থাপনা বেড়েই চলেছে বলে মত দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিপ্তরের দ্বন্দ্বে মহামারী মোকাবিলার কাজে স্থবির হয়ে পড়েছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর কারও আস্থা নেই। শৃঙ্খলার ঘাটতি আছে স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বত্র। যার কারণে সবার মধ্যে গা-ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে, যা খুবই বিপজ্জনক ।
করোনা পরীক্ষার নামে বাণিজ্য, ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট, লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল, সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর আইসিইউসহ মানহীন সরঞ্জাম এমনকি করোনার বিস্তার থেকে রক্ষা পেতে চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়েও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে। তার মধ্যে বেশি দুর্নীতি হয়: কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহ খাতে। এর বাইরে দুর্নীতি করার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা? এমন যন্ত্রপাতি কেনা হয় যা পরিচালনার লোক নেই? ওইসব যন্ত্রপাতি কখনই ব্যবহার করা হয় না?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সরকারের কার্যক্রমে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অযোগ্যতার কারণে করোনা ভাইরাস সংকট প্রকট হচ্ছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, পরিস্থিতির শুরু থেকে লকডাউনসহ সব পদক্ষেপের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলা নির্ভরতার কারণে অব্যাস্থাপনা বেড়েই চলেছে।
অনিয়ম এবং দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে অসহায় বা দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রভাব পড়ছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়তি দামে মানহীন মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষাসামগ্রী সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয়েছে। সে জন্য এসব কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণ একটি সিন্ডিকেটের হাতে থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
টিআইবি অভিযোগ করেছে যে, একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন ফার্মের নামে সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশ এতে জড়িত রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এন-৯৫ মাস্ক লেখা মোড়কে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করার বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণের উর্ধ্বগতি কিভাবে রোধ করবে তার কোন সদুত্তর কারো কাছে আছে বলে মনে হয় না।
শীর্ষনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন