অন্যসব তরুণীর মতো নুরজাহানেরও (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম আসল নাম প্রকাশ করা হয়নি) ছিল অনেক স্বপ্ন, ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা। বাংলাদেশের কুমিল্লার লাকসামের এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো ছিল না। ভারতে উন্নত জীবনের আশায় অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল নুরজাহান। এ জন্য সে এক দালালের সাহায্য নেয়। এরপর তার মন্দ ভাগ্য তাকে ভারতের একাধিক শহরে নিয়ে যায়।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ফেরার সময় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফের হাতে ধরা পরে ১৬ বছর বয়সী নুরজাহান। গত বৃহস্পতিবার ভারতের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সীমান্ত থেকে তাকেসহ আরো এক বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে বিএসএফ।
গ্রেপ্তার হওয়া অপর বাংলাদেশির নাম সুরোদ বিশ্বাস (২৬)। তিনি বাংলাদেশের যশোর জেলার বাসিন্দা।
মুম্বাই থেকে ফেরার পথে নুরজাহানের সঙ্গে দেখা হয় সুরোদের। আগে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে বিএসএফের গোয়েন্দা শাখা তাদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য ফাঁদ পেতে রাখে। তাদেরকে পরবর্তী তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচবেরিয়া সীমান্ত পোস্টে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলে। মামলায় নুরজাহানের বয়স ১৮ লেখা হয়, যদিও সে বিএসএফকে জানিয়েছিল তার বয়স ১৬।
বাংলাদেশে থাকাকালীন নুরজাহান ভারতের বেঙালুরুর শান্তা আফ্রিন জারা নামে একজনের সঙ্গে ফেসবুকে কথা বলে। যদিও নুসরাতের মা ওই বন্ধুর নাম বলেছে ইসরাত। এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি শান্তা ও ইসরাত একই ব্যাক্তি কিনা। আউটলুকের তদন্ত থেকে জানা যায়, নুরজাহান ভারতে আসলে তাকে বিউটি পার্লারে কাজের কথা বলে শান্তা। তারা কাজ করতেন বাংলাদেশের নড়াইল জেলার সবুজ নামের একজনের অধীনে। ভারতে যাওয়ার জন্য নুরজাহান যোগাযোগ করে সাতক্ষীরা জেলার আরুল নামের একজনের সঙ্গে। তিনিই নুরজাহানকে নিরাপদে সীমান্ত পাড় করে দেন। এজন্য তাকে দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার পর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় নুরজাহান। সেসময় পুলিশকে ৭০ হাজার রুপি দিয়ে ছাড়া পায় সে।
মার্চ মাসে সবুজের সহায়তায় কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু পৌঁছায় নুরজাহান। কিন্তু বিউটি পার্লারে কাজের পরিবর্তে তাকে একটি পতিতালয়ে নিয়ে আসে সবুজ। তাকে নিয়মিত মাদক প্রয়োগ করা হতো। এরপর তাকে চেন্নাই নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাকে একাধিক শহরে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। গত ২২শে এপ্রিল এক প্রকৌশলীর সঙ্গে দেখা হয় নুরজাহানের। তাকে নিজের সব কথা খুলে বললে, সেই প্রকৌশলী নুরজাহানকে সাহায্য করতে চান। তিনি তাকে ১০০০ রূপি প্রদান করেন এবং স্থানীয় পুলিশের কাছে তাকে পৌঁছে দেন। তার কাছে একটি ভুয়া আধার কার্ড রয়েছে, যাতে তার নাম দেখানো হয়েছে রিতা। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বানজারা হিল পুলিশ স্টেশনে। তবে কোভিড পরিস্থিতির কারণে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
আউটলুক নুরজাহানের মা-বাবাকে খুঁজে বের করে। বর্তমানে তারা ঢাকার তেজগাঁ এলাকায় থাকেন। তার বাবা টেলিফোনে জানান, নুরজাহান অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। সে ভারতে গিয়েছিল তার চাচার সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু আমরা জানি না সে এখন কোথায় আছে। যদিও তার মা জানান, ইসরাত নামের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ভারত গিয়েছে নুরজাহান।
২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার বন্ধে একটি আইন প্রণয়ন করে। এরপর এই আইনের অধীনে ৬০০০টি মামলা হয়েছে এবং ১০ হাজার জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে ১১ শতাংশই ছিল শিশু এবং ২১ শতাংশ নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, ২০১২ সালের ওই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার নুরজাহানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সকল আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ ও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে এ ধরণের অভিযোগ যেহেতু দুই দেশের মধ্যেকার বিষয়, তাই নুরজাহানের বাংলাদেশে ফিরে আসা নির্ভর করছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা পার¯পরিক সহযোগিতার ওপর। দুই দেশের মধ্যে এ ধরণের সমঝোতা রয়েছে বলে জানান তাসলিমা ইয়াসমিন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন