যুগান্তর : করোনা মহামারির মধ্যে আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেট আসতে যাচ্ছে। এটি একটি বিশাল বাজেট। বিশেষ সময়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি বিশেষ বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে। করোনার আঘাত মোকাবিলার জন্য গত বাজেটে বিশেষ কিছু লক্ষ করা যায়নি। সেটি ছিল আগের বছরগুলোর মতোই গতানুগতিক।
তবে এবার বাজেট হওয়া উচিত কোভিড-উত্তর বাজেট। কিভাবে এ সংকটাপন্ন পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যায়, সেটির নীতিকৌশল থাকা জরুরি এ বাজেটে। আবার শুধু নীতিকৌশল নিলেই চলবে না, সেটির বাস্তবায়ন করাও অত্যন্ত জরুরি।
যুগান্তর : আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : ব্যাংকিং খাতের কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ, বিদেশে টাকা পাচার এবং স্বজনপ্রীতিমূলক ব্যাংকিং বন্ধ করতে হবে। আর কোনো নতুন ব্যাংক দরকার নেই। বিশেষ করে গোষ্ঠীভিত্তিক ব্যাংক না দিয়ে দুর্বল ব্যাংককে সবল করতে হবে।
বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না। এটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা আরও সুনিপুণ ও সুদৃঢ় হওয়া উচিত। অনিয়ম শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়, পুঁজিবাজারেও রয়েছে। পুঁজিবাজারে কিছু লোক আছে যারা ইনসাইড ট্রেডিং করেন, তাদের দমনে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
যুগান্তর : করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকানোর জন্য যখন লকডাউনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেই সময়ে আবার আসছে বাজেট। এবারের বাজেটে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখতে পারছেন?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : চ্যালেঞ্জের মধ্যে স্বাস্থ্য খাত অন্যতম। এ খাতে শুধু অর্থ বরাদ্দ দিলেই চলবে না। সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। কেনাকাটায় অন্যায়-দুর্নীতি যাতে না হয় সে বিষয়ে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। এ ছাড়াও অর্থনীতির চালিকাশক্তি কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে এসএমই, সিএমএসএমই, পোল্ট্রি খামারসহ বিভিন্ন প্রান্তিক উদ্যোগকে আরও সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত। একইসঙ্গে প্রবাসীদের দিকেও নজর দেওয়া দরকার।
এ সময় আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিক নিরাপত্তা। যেসব নিম্ন আয়ের বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার রয়েছে, তাদের কাজের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু কাগজে না রেখে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা না নিলে প্রকৃতপক্ষে কেউ-ই উপকৃত হতে পারবে না। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বা এডিপির ছোটখাটো ও অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বরাদ্দ বাদ দিতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণকে সংযুক্ত করা উচিত।
গুটিকয়েক দলীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন আনা যাবে না। স্বেচ্ছাসেবক দল এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা কাজ করছেন তাদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে।
এবারের বাজেটে সরকারের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজস্ব আহরণ। কারণ করোনার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। ইতোমধ্যে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান লোকসান গুনছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প রয়েছে।
দিনমজুরদের আয় একেবারে কমে গেছে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য অনেক বরাদ্দ দিতে হবে। অন্যদিকে রাজস্ব আহরণ খুবই করুণ অবস্থায়। করোনার কারণে বিভিন্ন খাতে রাজস্ব আদায় কমছে। ফলে রাজস্ব আদায় এবারের বাজেটে অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
যুগান্তর : ঘাটতি মোকাবিলার উপায় কী হতে পারে?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : ঘাটতি আগের চেয়ে বাড়বে, এটা বাস্তবতা। এ কারণে রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো কর বাড়ানো যাবে না, তবে করের আওতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া বৈদেশিক উৎস থেকে ধারের চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দাতাদের কাছ থেকে অনুদান নিতে হবে। না পারলে স্বল্প সুদে কীভাবে ঋণ নেওয়া যায়, সে চেষ্টা করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ফান্ডসহ দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ যত কম নেওয়া যায়, ততই ভালো। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণ বেশি নিলে আবার বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যুগান্তর : কোন কোন খাতে ব্যয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বাড়াতে হবে। করোনার কারণে অনেক লোক কর্ম হারিয়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। সামনে আরও যাবে। জীবন-জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র।
যুগান্তর : প্রতি বছরই বাজেটে কিছু দুর্বল দিক থাকে, উল্লেখযোগ্য দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : প্রতি বছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সংশোধিত বাজেটে তা কমানো হয়। পুরো এডিপি বাস্তবায়ন হয় না। অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গুণগতমান খুবই দুর্বল। ফলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প নির্বাচন, পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া, যথাসময়ে বাস্তবায়ন ও গুণগতমান নিশ্চিত করা জরুরি। এর মধ্যে কিছু বরাদ্দ একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে এর খুব বেশি ভূমিকা নেই। এরপরও রাজনৈতিক কারণে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এটি যৌক্তিক নয়। এ ছাড়া দুর্নীতিও বাজেট বাস্তবায়নে বড় বাধা। সরকারের অনেক কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অপচয় হয়। এগুলো বাজেটের উল্লেখযোগ্য দুর্বল দিক। এসব বন্ধ করতে না পারলে বাজেটের সুফল জনগণ পাবে না।
যুগান্তর : বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : করোনা অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বকে দুর্বল করে দিয়েছে। বিশেষ করে দারিদ্র্যের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। জীবনযাত্রার মানের অবনতি ঘটেছে। বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মহীন। তবে কোনো দেশই একেবারে মরে যায়নি। মহামারি বিভিন্নভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। বাংলাদেশেও করোনার কারণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দেওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়বে। তবে সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
যুগান্তর : করোনা মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। দেশে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : করোনার কারণে বিশ্ব অর্থব্যবস্থা ধীরে ধীরে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা তো খুবই নাজুক। যেসব দেশে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, সেসব দেশে প্রকোপ আরও বাড়ছে। এতে রফতানি প্রবৃদ্ধির হার কমবে।
বর্তমানে রফতানি প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নিচের দিকে। আমদানির চিত্রও প্রায় একই। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কারণ বিনিয়োগের অনেকটাই আমদানিনির্ভর। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এগুলোর আমদানি কমে গেলে বুঝতে হবে বিনিয়োগ কমে গেছে।
যুগান্তর : বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে করণীয় কী?
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : করোনা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর করোনার আগে থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ ছিল। বিনিয়োগের পরিবেশটা আগে তৈরি করতে হবে। আস্থাহীনতা দূর করতে হবে। বাজেটে যে আশ্বাস প্রদান করা হয় তার বাস্তবায়ন ও বিশ্বাস তৈরি করতে হবে। তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ : ধন্যবাদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন